দিন দিন সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ার পেছনে কিছু কারণ চিহ্নিত করে চার দফা নির্দেশনা এসেছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুর রহমান পায়েল হত্যা মামলার রায়ে। ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান রোববার চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, “এ রকম অনেক পায়েল মারা যায়, যাদের কথা আমরা জানতে পারি না। সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন হত্যার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যা বলাটা বোধ হয় ভুল নয়।”
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান পায়েল ২০১৮ সালের ২১ জুলাই রাতে চট্টগ্রাম থেকে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে করে ঢাকা ফিরছিলেন। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া এলাকায় গাড়ি যানজটে পড়ায় প্রস্রাব করার কথা বলে বাস থেকে নেমেছিলেন তিনি। বাস চলতে শুরু করলে তিনি দৌড়ে এসে ওঠার সময় দরজার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সংজ্ঞা হারান। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে দেখে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার বদলে দায় এড়াতে ভাটেরচর সেতু থেকে নিচের খালে ফেলে বাস নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন চালক, হেলপার ও সুপারভাইজার। পায়েলকে অচেতন অবস্থায় সেতু থেকে খালে ফেলে দেওয়ার আগে তার পরিচয় গোপন করতে বাসচালক মুখ থেঁতলে দেওয়া হয় বলে এ মামলার বিচারে উঠে আসে। ওই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে বাস চালক জামাল হোসেন, তার সহকারী ও ভাই ফয়সাল হোসেন এবং সুপারভাইজার জনিকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে আদালত।
২৬ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারক বলেছেন, “সড়কগুলোত প্রতিদিন প্রাণ দিচ্ছে বহু মানুষ। কোনোভাবেই যেন মৃত্যুর এ মিছিল থামছে না। অত্র মামলার সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা যায়, মামলার ঘটনাটি দুঃখজনক। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মো. সাইদুর রহমান পায়েলকে চিকিৎসা না দিয়ে অচেতন অবস্থায় ভাটের চর ব্রিজ থেকে নিচের ফুলদি নদীতে ফেলে দেয় আসামিরা। তখনও আহত পায়েল জীবিত ছিল। পরে ফুলদী নদী থকে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে।”
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, গাড়ি চালকের অদক্ষতা, বেপোয়োয়া চালনা, চলাচলের অযোগ্য রস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি- এসব কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। “সড়কে প্রতিদিন এই দুর্ঘটনা কি নিছক দুর্ঘটনা না হত্যা- এ নিয়ে সবার মনে প্রশ্ন উঠেছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদেরও পিষে দিতে এরা দ্বিধান্তিত হচ্ছে না।”
রাজধানীতে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম মীম ও আবদুল করিম রাজীবের মৃত্যুর ঘটনাসহ দেশের ২১টি আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯ জনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে বিচরক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান বলেন, “সড়কে এত মৃত্যু এখনও আমাদের সচেতন করে না। তাহলে কবে সচেতন করবে?”
আদালতের চার সুপারিশ
১. গাড়ির চালক, তার সহকারী ও সুপারভাইজার মাদক সেবন করেছেন কিনা জানতে গাড়ি ছাড়ার আগে কাউন্টারে, পথে বিরতির স্থানে এবং গাড়ি গন্তব্যে পৌছানোর পর মোট তিন দফা ডোপ টেস্ট করাতে হবে।
২. গাড়ির চালক, তার সহকারী ও সুপারভাইজার প্রায়ই যাত্রীদের সঙ্গে ‘অভদ্র আচরণ’ করেন। এ ক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই ‘নম্র ভদ্র’ আচরণ করতে হবে। গাড়ি চালানোর বিষয়গুলোর পাশাপাশি যাত্রীদের সঙ্গে আচরণের বিষয়েও তাদের কাউন্সেলিং ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. মহাসড়কে প্রতি তিন কিলোমিটার পর পর চালক ও যাত্রীসহ সবার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আধুনিক বাথরুম ও টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে, যা বিনে পয়সায় ব্যবহার করা যাবে। সেজন্য বাস মালিকরা সরকারের সড়ক বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে নির্ধারিত হারে চাঁদা দেবেন।
৪. মহাসড়কে সি সি ক্যামেরার মাধ্যমে যানবাহন চলাচলের ওপর নজরদারি জোরদার করতে হবে।
রায়ে বিচারক বলেন, “ভিকটিম পায়েল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ও প্রতিভাবান ছাত্র ছিল। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে সে দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করার জন্য নিজেকে তৈরি করছিল। সেই মুহূর্তে বাস ড্রাইভার, সুপারভাইজার ও হেলপারের নির্মমতার শিকার হয়ে তাকে অকালে প্রাণ দিতে হল। “তার এ অকাল মৃত্যতে তার পরিবার আজ শোকে নির্বাক ও হতাশায় নিমজ্জিত । ছেলে হারানোর এই শোক কোনোভাবেই সামলানো সম্ভব না বিধায় নিকৃষ্ট এই খুনের জন্য সকল আসামিকে সব্বোর্চ শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল।” সূত্র : বিডিনিউজ।
খুলনা গেজেট/কেএম