জেডিসি কিংবা এসএসসি পাশের আগেই স্বামীর সংসারে যেতে হয়েছে তাদের। সেখানে কোল জুড়ে আসে সন্তান। কেউ আবার গর্ভবতী অবস্থায় দিয়েছেন পরীক্ষা। কাউকে আবার পরীক্ষা চলাকালীন কেন্দ্রেই সন্তানকে পান করতে হয়েছে বুকের দুধ। বিয়ের পর থেকে স্বামীর খেদমতসহ সংসারের কাজতো করেই চলেছেন তারা। তবুও অদম্য ইচ্ছায় থেমে নেই উপকূলের নারীরা। এসএসসি/দাখিলের মত এইচএসসি/ আলিমেও আল্লাহর কৃপায় সফল তারা। উপকূলীয় উপজেলা খুলনার কয়রার নারীরা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতির সম্মুখীন, দারিদ্রতা, বিয়ে, সংসার, স্বামীর সাথে সুসম্পর্ক বজায়, সন্তান লালন-পালন, সমাজের বাধাসহ নানা প্রতিবন্ধকতাকে পিছনে ফেলে শিক্ষা জীবনে সফলতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন। আজ এমনি কয়েকজন অদম্য নারীদের গল্প তুলে ধরছি।
রেদওয়ানা আক্তার মীম: দুই সন্তানের জননী মীম। কয়রা উপজেলার দেয়াড়া পশ্চিমপাড়ার মুদি ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিনের দুই মেয়ের মধ্যে বড় তিনি। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াবস্থায় পাশবর্তী শিমলার আইট গ্রামের নাসির হোসেনের সাথে বিয়ে হয় তার। স্বামী মৎস্য দপ্তরের একটি প্রকল্পে চাকরী করেন। চাকরির সুবাদে বিয়ের পরে স্বামীর সাথে চলে যেতে হয় ভিন্ন উপজেলায়। বিয়ের পরে বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলেও পরবর্তীতে স্বামীর অনুপ্রেরণা তার পড়ালেখার গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। সংসার সামলানোর পাশাপাশি বাসায় বসে লেখাপড়া চালু রাখেন তিনি। শিক্ষিত হওয়ায় বাড়িতে পাঠদানে সহযোগীতা করতেন তার স্বামী । একপর্যায়ে জয়পুর শিমলারআইট দারুচ্ছুন্নাহ দাখিল মাদ্রাসা থেকে ২০১৭ সালে জিপিএ-৪.৫৫ নিয়ে জেডিসি পাশ করেন। পরে একই মাদ্রাসা থেকে ২০১৯ সালে গর্ভবতী অবস্থায় জিপিএ-৪.০৬ নিয়ে দাখিল পাশ করেন তিনি। পরবর্তীতে তার কোল জুড়ে আসে ছেলে সন্তান। পরে আলিম পরীক্ষার ৩ মাস পূর্বে আরও একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। ৩ মাস বয়সের ছেলেকে কেন্দ্রে নিয়ে এবারের আলিম পরীক্ষায় কালনা আমিনিয়া ফাজিল মাদ্রাসা থেকে জিপিএ-৪.৩৬ অর্জন করেছেন। সর্বদা স্বামীর একান্ত সহযোগীতা ও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
শামীমা আক্তার: খুলনার রূপসা উপজেলার তালিমপুর গ্রামের কাঠ ব্যবসায়ী কামাল হোসেনের মেয়ে শামীমা। ১০ম শ্রেণিতে পড়াবস্থায় বিয়ে হয় কয়রার দেয়াড়া পশ্চিমপাড়ার নিম্নবিত্ত পরিবারের মুজাহিদ নামের এক অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সাথে। তার স্বামী দারিদ্রতার কষাঘাতে খুলনা শহরে ইজিবাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি উভয়ের পড়াশুনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন। রূপসা উপজেলার নৈহাটী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে জিপিএ-৩.৯৭ নিয়ে বাণিজ্য বিভাগ থেকে এসএসসি পাশ করেন। ভর্তি হয় খুলনার সরকারী পাইওনীয়ার মহিলা কলেজে। পরবর্তীতে গর্ভে সন্তান ধারণ করেন এবং সেই সন্তানকে লালনপালনের পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে যান। তবে অর্থাভাবে গেল বছরের ফরম পূরণ করতে পারিনি। পারলে হয়ত অটোপাশের আওতায় গেল বছর উত্তীর্ণ হয়ে যেত। এবার পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা নিয়ে শেষের দিকে কয়েক মাস কোচিং করেন তিনি, ঋণ নিয়ে করেন ফরম পূরণ। তিনি ওই কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে জিপিএ- ৪.৩৩ পেয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তার ছেলের বয়স এখন প্রায় ৩ বছর।
মর্জিনা: খুলনার দাকোপ উপজেলার নলীয়ান গ্রামের মোঃ মোস্তাইন সানার মেয়ে মর্জিনা। তার পিতা সমুদ্রে মাছ ধরেন। ১০ম শ্রেণিতে থাকাবস্থায় বিয়ে হয় কয়রা উপজেলার বাগালী গ্রামের ইদ্রিস হোসেনের সাথে। দাকোপের নলীয়ান দাখিল মাদ্রাসা থেকে ২০১৮ সালে জিপিএ- ৪.৬৫ নিয়ে দাখিল পাশ করেন। পরীক্ষার পরে গর্ভে সন্তান ধারণ করেন। দারিদ্রতাসহ নানা প্রতিকূলতায় কৃতিত্বের সাথে পাশের পরেও আলিমে ভর্তি হতে পারেননি তিনি। কিন্তু প্রবল ইচ্ছায় পরের বছর স্বামী ও পরিবারের সহযোগীতায় আলিম ভর্তি হন কয়রার ঘুগরাকাটি আহম্মেদীয়া ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসায়। সংসার সামলানোর পাশাপাশি বাড়িতে বসে চালু করেন লেখাপড়া। প্রাইভেটও পড়েছেন কিছুদিন। এ বছরের আলিম পরিক্ষায় জিপিএ-৪.৩৬ অর্জন করেছেন তিনি। স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞ তিনি।
সিদ্দিকা ইয়াসমিন: বিয়ে হয় সপ্তম শ্রেণিতে পড়াবস্থায়। এখন সন্তানের বয়স ২ বছরের বেশি। প্রবল ইচ্ছার কাছে পরাজিত প্রতিবন্ধকতা। বিয়ের আগেই কথা ছিল পড়ালেখায় বাধা দিতে পারবে না স্বামী। যতদূর পড়ালেখা চালিয়ে যাবে ততদুর সহযোগীতা করার আশ্বাস দেন তার স্বামীও। সে অনুযায়ী বিয়ের পরে কয়রার শিমলার আইট গ্রামের আলমগীর হোসেনের সংসারে চলে আসেন। বর্তমানে আলমগীর কয়রায় এক আইনজীবীর সহকারী হিসেবে কর্মরত আছেন। পরে ইয়াসমিনের পিতার বাড়ি থেকে এনে বাড়ির পাশের জয়পুর শিমলার আইট দারুচ্ছুন্নাহ দাখিল মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেন তার স্বামী। সংসারের পাশাপাশি পড়া চালিয়ে ২০১৭ সালে জেডিসিতে জিপিএ-৪.৭৫ নিয়ে পাশ করেন তিনি। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৯ সালে দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ-৪.৬৫ নিয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। পরে গর্ভে সন্তান ধারণ করেন। এবারের আলিম পরীক্ষায় কালনা আমিনিয়া ফাজিল মাদ্রাসা থেকে জিপিএ-৪.৬৪ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি মদিনাবাদ গ্রামের মিজানুর রহমান নামের এক কৃষকের মেয়ে।
শুধু মীম, শামীমা, মর্জিনা ও ইয়াসমিন নয়, উপকূলীয় প্রতিকূলতার সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে থাকা বহু নারী বিয়ের পরেও সাফল্যের সাথে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেয়াড়া পশ্চিমপাড়ার আরেক নারী বিয়ের পরেও এবছর কয়রা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে জিপিএ-৫ অর্জন করেছেন। তিনি এসএসসিতে জিপিএ- ৪.৬৩ ও জেএসসিতে ৪.৮৩ অর্জন করেছিলেন। তবে অধিকাংশ মেধাবী ছাত্রীরা দারিদ্রতার কষাঘাতে মেধার বিকাশ ঘটাতে পারছেন না। ঝরে পড়ছে অকাতরে। এইসএসসি পাশের পর বিয়ে হলেও অর্থাভাবসহ নানা প্রতিকূলতায় স্বামী পরিবারের সহযোগীতা না পেয়ে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে এমন নারীও একাধিক রয়েছে।
কয়রা লেডিস ক্লাবের সভাপতি বিপাশা বিশ্বাস বলেন, প্রথমে আমি শুভকামনা জানাচ্ছি উপকূলের অদম্য নারীদের স্বামীদেরকে। তাদের সহযোগিতায় এবং নিজেদের একান্ত চেষ্টায় তারা আজ স্বপ্ন জয়ের পথে। উপকূলের নারীরা যেনো পিছিয়ে না থাকে এই প্রত্যাশা করছি।
কয়রা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রেশমা আক্তার রুমি বলেন, বাল্যবিবাহের মত সেই বাধা কেও টপকিয়ে স্বামী, সন্তান, সংসার সামলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রান্তিক সমাজের অদম্য এ-সব নারীরা। এসকল অদম্যদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। তাদের জন্য দোয়া রইল যেন আল্লাহর কৃপায় সফলতার চূড়ায় পৌঁছাতে পারে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে শুধু নিজেদেরকেই নয় পুরো পরিবার, সমাজ এমনকি বিশ্বকে-ই আলোকিত করবে ইনশাল্লাহ। আমরাও চেষ্টা করব উপজেলা প্রশাসন থেকে তাদের পাশে থাকার।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, উপকূলীয় জনপদের নারীরা পিছিয়ে না থেকে পুরুষের সাথে সমান তালে এগিয়ে যাক এটা সবারই প্রত্যাশা। তবে তারা যাতে বাল্যবিবাহের শিকার না হয়, এ ব্যাপারে সচেতন থাকার জন্য সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
খুলনা গেজেট/ টি আই