মাঠে মাঠে দুলছে সোনালি ধান। পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। সড়কের পূর্বপাশে সোনালি ফসলের মাঠে গ্রামবাসীর জটলা। একটি যন্ত্রে চলছে ধান কাটার কাজ। সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছেন ধান কাটার দৃশ্য। অল্প সময়ে মাঠের ধান কর্তন ও ঝাড়াই-মাড়াই করতে দেখে উৎসুক জনতার মুখে হাসি। চলছে নানা গুঞ্জনও। ধান কাটা শেষে কেউ কেউ স্বচ্ছ ধান হাতে নিয়েও দেখছেন। এমন এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের দেখা মেলে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার কাপালিডাঙ্গা গ্রামে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মাঠে ধান পাকার পর অনেক সময় শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। বোরো ধান কাটার সময় আগাম বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। যে কারণে শ্রমিক সংকট থাকায় দ্রুত কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াই করা সম্ভব হয় না। কৃষকের এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সরকার খামার যান্ত্রিকীকরণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। ধান কাটার যন্ত্র রিপার, কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও মাড়াই যন্ত্রে ৫০ থেকে ৭০ ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে। এই কার্যক্রমে উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসতে শুরু করেছে।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এবার খুলনায় ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। জেলায় ধানের আবাদ হয়েছে ৬০ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে। আর ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৮২১ মেট্রিক টন।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মো. শরিফুল ইসলাম একটি হারভেস্টার মেশিন কিনেছেন। এই যন্ত্রটি ব্যবহারে কৃষকের নানা সুফল রয়েছে বলে জানিয়েছেন শরিফুল ও কৃষি কর্মকর্তারা। এই যন্ত্রটি দিয়ে দ্রুত ধান কাটা, শ্রমিকের অভাব দূরীকরণ, স্বল্প খরচ, ফসলের ক্ষতি কম, একই সঙ্গে ঝাড়াই-মাড়াই ও বস্তাবন্দি করা সম্ভব।
ডুমুরিয়া উপজেলার কাপালিডাঙ্গা গ্রামের কৃষক কমলেশ বিশ্বাস বলেন, এক বিঘা জমি জোন (শ্রমিক) দিয়ে কাটা, মাড়াই করতে ৭ হাজার থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকা খরচ হয়। সেখানে মেশিনে কাটালে সময়ও কম লাগছে এবং খরচ হচ্ছে মাত্র সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এতে অনেক টাকা লাভবান হচ্ছি আমরা। সাধারণত ধান কাটার পর ২/৩ দিন রোদে শুকিয়ে তারপর ঘরে নিতে হয়। কিন্তু এখানে সঙ্গে সঙ্গে আমরা ধান পাচ্ছি। এক্ষেত্রে ঝড়-বৃষ্টিতে ক্ষতি হবে না। এটা খুব ভালো প্রযুক্তি।
মেশিনের অপারেটর মো. মামুন বলেন, মেশিনটির কয়েকটি ধাপ রয়েছে। সামনের অংশ কাটিং ইউনিট। এটি ধান গাছকে ধরে ভেতরে ব্লেডের সাহায্যে কেটে দেওয়ার পর কম্বিনেশন কয়েকটি চেইনের মাধ্যমে ধান গাছটি টেনে নিয়ে যায় ভেতরে। এরপর লিফটিং চেইনের মাধ্যমে ধান গাছটি ফিনিশিং ড্রামের মধ্যে প্রবেশ করে। সেখানেই মূলত মাড়াইয়ের কাজটি হয়। পেছনের দিকটি খড় ডেলিভারি পয়েন্ট। এর মাধ্যমে খড়গুলো সুন্দর করে গোছালোভাবে নিচে পড়ে। মাড়াই হওয়ার পরে ধান শস্য ট্যাংকে গিয়ে জমা হয়। শস্য ট্যাংকে ৬০০ কেজি ধান রাখার ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। ইঞ্জিনের মাধ্যমে ধান কাটা, ঝাড়া মাড়াইসহ চারটি কাজ করে থাকে।
মেশিনের মালিক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, মেশিনটি কিনেছি ৪/৫ দিন হলো। আগে দুই জায়গাতে কেটেছি। আজ এখানে কাটছি। মেশিনে ধান কাটতে বিঘা প্রতি এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা খরচ হয়। কৃষকদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ হাজার টাকা থেকে চার হাজার টাকা নিয়ে থাকি। এই ধান জোন দিয়ে কাটালে সর্বনিম্ন ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়। তারপরও ঝাড়াসহ যেকোন সময় বৃষ্টিতে তলিয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, আগে ধান কেটে ৫/৭ দিন ফেলে রাখতে হতো। এতে বৃষ্টি হলে ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকত। কিন্তু মেশিনে এক ঘণ্টার মধ্যে এক একর জমির ধান কেটে মাড়াই করে বাড়ি নিয়ে যেতে পারছে। অল্প সময়ে মানুষ ঘরে ধান তুলতে পারছে।
করোনাকালীন শ্রমিক সংকট নিরসনে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কারণ লকডাউনের কারণে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। আবার শ্রমিকের মূল্যও অনেক বেশি। এখন এক সপ্তাহের জন্য শ্রমিক নিলে প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দিতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এক বিঘা জমির ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই করতে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা লেগে যায়। এক একর জমির ধান তুলতে ২২ হাজার থেকে ২৩ হাজার টাকা খরচ হয়। সেক্ষেত্রে কম্বাইন্ড হারভেস্টিং মেশিন এক সঙ্গে অনেকগুলো কাজ করে। ধান কর্তন, মাড়াই, ঝাড়াই এবং বস্তাবন্দি করা যায়।
মো. মোসাদ্দেক হোসেন, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, ডুমুরিয়া তিনি আরও বলেন, সরকারি সুবিধা অনুযায়ী ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। কেউ যদি মেশিনটি কিনতে চায় তাহলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও কৃষি কার্ড নিয়ে একটি ছাড়পত্র নিলে মেশিনটি ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে কিনতে পারবে। এই যন্ত্র এক ঘণ্টায় এক একর জমির ধান কাটতে পারে।
এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, এটি উপকূলীয় ও দূর্যোগপূর্ণ এলাকা। এখানে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা বৃষ্টি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ধান পাকার পর মাঠে রাখলে ক্ষতি হতে পারে। এই যন্ত্রের মাধ্যমে কেটে পরিষ্কার ধান নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে কৃষক। এতে শ্রমিক এবং অর্থ দুটোই সাশ্রয়ী হচ্ছে।
খুলনা গেজেট/কেএম