সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার কারণ খুঁজছেন গোয়েন্দারা। কেন, কী কারণে পার্শ্ববর্তী দেশে নিয়ে তাঁকে খুন করা হলো, তার স্পষ্ট উত্তর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নেই। তবে বেশ কিছু সন্দেহ সামনে রেখে তদন্ত করছেন বাংলাদেশ ও ভারতীয় গোয়েন্দারা। তবে এখন পর্যন্ত স্বর্ণ চোরাচালানের বিপুল অর্থের ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে আজীমকে হত্যা করা হয়েছে ধারণা করা হচ্ছে। আজীম ও তাঁর বন্ধু ঠিকাদার আখতারুজ্জামান শাহীনের এপার-ওপারে যৌথ ব্যবসা আছে। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী শাহীনের সঙ্গে আজীমের অর্থের ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ চলছিল। ঠিকাদারির পাশাপাশি হুন্ডির কারবার রয়েছে ওই বন্ধুর।
হত্যা মিশনে শাহীন তাঁর বেয়াই চরমপন্থি নেতা আখতারুজ্জামানকে ব্যবহার করেছে। ব্যবসায়িক বিরোধের বাইরে কয়েক বছর আগে চুয়াডাঙ্গায় সাইফুল হত্যা এবং আরও এক চরমপন্থি নেতার খুনের প্রতিশোধ নিতে আজীমকে সরিয়ে দেওয়া হলো কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ ছাড়া কোনো স্বার্থান্বেষী গ্রুপ একত্রিত হয়ে গোপন ছকে এই আজীম হত্যার মিশনে সংশ্লিষ্ট কিনা, সেটি তদন্ত করছেন গোয়েন্দারা। ঝিনাইদহকেন্দ্রিক আজীমের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা অনেক দূর থেকে হত্যা পরিকল্পনায় জড়িত– আছে সেই আলোচনা। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, কী কারণে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তা জানতে তদন্ত চলছে। এটা পারিবারিক নাকি আর্থিক অথবা এলাকায় কোনো দুর্বৃত্ত দমন করার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা, সবকিছু তদন্তের আওতায় আনা হবে। এটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড– এটা মনে করেই তদন্ত কর্মকর্তারা কাজ করছেন। নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। কয়েকজন ডিবিতে আছে, তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা সবকিছু বলতে পারছি না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আজীমের পৈতৃক বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মধুগঞ্জ বাজার এলাকায়। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা তিনবার তিনি এমপি নির্বাচিত হন। তবে তাঁর অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এক সময় দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সীমান্তপথে অস্ত্র ও বিস্ফোরক পাচারের হোতা হিসেবেও পুলিশের তালিকায় তাঁর নাম ছিল। আজীমের বিরুদ্ধে অস্ত্র-বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং চরমপন্থিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে মামলা রয়েছে।
২০০৭ সালে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুর এলাকা থেকে ১২ কেজি ৯৫০ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি)। চোরাকারবারিরা জানতে পারে, সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম এই চালান ধরিয়ে দিয়েছেন। এর পর তাঁকে হত্যা করা হয়। ওই মামলায় আজীমসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তবে ২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় আনারসহ বেশ কয়েকজন মামলা থেকে অব্যাহতি পান। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আজীমের বিরুদ্ধে থাকা অন্য মামলাগুলো থেকেও তিনি অব্যাহতি পেতে শুরু করেন। আর ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর বেশির ভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন তিনি।
এলাকায় আলোচনা আছে– অবৈধ কারবারের মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যান এমপি আজীম। ১৯৯১ সালে ঝিনাইদহের আরেক চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুরের সঙ্গে মিলে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এর পর কালীগঞ্জ পৌরসভার এক কাউন্সিলরের হাত ধরে অস্ত্র চোরাকারবারে জড়ান।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে যা বলা হয়
জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের ২২ মার্চের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, পরপর দুইবার এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগে দলাদলিসহ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আধিপত্য বিস্তারে পেশিশক্তি ব্যবহার করেন আজীম। এ কাজে তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যসহ বিরোধীদলীয় এবং বিতর্কিত নেতাকর্মী ব্যবহার করেছেন। তিনি একক আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী এবং জনপ্রতিনিধিদের আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটিতে স্থান দিয়ে দলে ভিড়িয়েছেন। দলের ত্যাগী ও একনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা কমিটি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় এমপির সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীর কোন্দল ও বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এমপি আজীমের ছত্রছায়ায় উপজেলায় টেন্ডারবাজিসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আধিপত্য বিস্তার করছেন কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শিবলী নোমানী এবং তাঁর ভাই পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মন্টু। তাদের বাবা প্রয়াত মোমিন মৌলভী ছিলেন চিহ্নিত রাজাকার। শিবলী ও তাঁর ভাই কালীগঞ্জ পৌর বিএনপির নেতা ছিলেন। ২০০৮ সালে আজীমের নেতৃত্বে তাঁরা আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও খুলনা বিভাগীয় ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফরিদকে পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির পদ দেন আনার। উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও উপজেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান লালকে নিজের ঠিকাদারি কাজে ব্যবহার করছেন। ছাত্রশিবির ও ইউনিয়ন যুবদলের দুই নেতাকেও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পদ দিয়েছেন।
খুলনা গেজেট/এইচ