মুসলিম ব্যক্তিকে প্রকৃত মুসলিমের গুণে ভূষিত হতে হলে তাকে আল্লাহর কিতাব ও নবী ﷺ এর সুন্নাহ’র শিক্ষা ও দর্শনের ভিত্তিতে জীবন পরিচালিত করতে হবে; সুতরাং সে কুরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে জীবনযাপন করবে এবং সে অনুযায়ী তার সকল বিষয়কে রূপায়িত করবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَن يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدْ ضَلَّ ضَلٰلًا مُّبِينًا
অর্থঃ আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন এখতিয়ার নেই, যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্ট তায় পতিত হয়। -সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৬
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন: আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেয়, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে, তা থেকে বিরত থাক। – সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৭
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا لِمَا جِئْتُ بِهِ
তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ইচ্ছা ও খেয়াল-খুশিকে আমি (যে দ্বীন) নিয়ে এসেছি তার অনুগামী করবে। -আস-সুন্নাহ ইবনে আবি আসেম, হাদীস-১৫
সুতরাং স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে মুসলিম ব্যক্তি অবশ্যই নিম্নোক্ত আদবসমূহ রক্ষা করে চলবে, যা নবী করীম ﷺ এর বাণী থেকে সাব্যস্ত হয়েছে, তিনি বলেন:
الفِطْرَةُ خَمْسٌ، أَوْ خَمْسٌ مِنَ الفِطْرَةِ: الخِتَانُ، وَالِاسْتِحْدَادُ، وَنَتْفُ الإِبْطِ، وَتَقْلِيمُ الأَظْفَارِ، وَقَصُّ الشَّارِبِ
ফিতরাত (অর্থাৎ মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব) পাঁচটিঃ খাত্না করা, ক্ষুর ব্যবহার করা (নাভীর নিম্নে), বগলের পশম উপড়ে ফেলা, নখ কাটা ও গোঁফ খাটো করা। -সহীহ বুখারী, হাদীস-৫৮৮৯
এসব আদবের বিবরণ নিম্নরূপ:
১. খাৎনা করাঃ খাৎনা হল চামড়ার ঐ অংশ কেটে ফেলা, যা পুরুষাঙ্গের মাথাকে ঢেকে রাখে; আর এ কাজটি শিশুর জন্মের সপ্তম দিনে সম্পন্ন করা মুস্তাহাব; নবী করীম ﷺ হযরত ফাতেমাতুয যাহরা ও আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা’র দুই ছেলে হাসান ও হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমার খাৎনার কাজ তাদের জন্মের সপ্তম দিনে সম্পন্ন করেছেন। আর এ খাৎনার কাজটি বালেগ হওয়ার আগ পর্যন্ত বিলম্বিত করে সম্পন্ন করলেও দোষণীয় হবে না; আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম আশি বছর বয়সে খাৎনা করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে, যখন কোনো ব্যক্তি নবী করীম ﷺ এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করত, তখন তিনি তাকে বলতেন: তুমি তোমার কাফির অবস্থার চুলগুলো কেটে ফেলো এবং খাৎনা কর। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস-৩৫৬
২. গোঁফ খাটো করাঃ মুসলিম ব্যক্তি তার গোঁফ সম্পূর্ণ ছেটে ফেলবে অথবা ঠোটের উপর ঝুলে পরা গোঁফ কেটে ফেলবে। আর দাড়িকে লম্বা করবে, যতক্ষণ না তার মুখমণ্ডল পূর্ণ হবে; রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: তোমরা গোঁফ কেটে ফেল এবং দাড়ি লম্বা কর; আর (এভাবেই) তোমরা অগ্নি পূজকদের বিরুদ্ধাচরণ কর। তিনি আরও বলেন:
خَالِفُوا الْمُشْرِكِينَ أَحْفُوا الشَّوَارِبَ وَأَوْفُوا اللِّحَى
তোমরা মুশরিকদের বিপরীত করবে, তোমরা গোঁফ ছোট করবে এবং দাড়ি লম্বা রাখবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস- ৪৯০
অর্থাৎ দাড়ি লম্বা করতে আদেশ করা হয়েছে; সুতরাং সর্বসম্মতিক্রমে দাড়ি মুণ্ডন করা বা এক মুষ্ঠির কম ছেটে ফেলা না জায়েয; আর মুসলিম ব্যাক্তির জন্য মাথার কিছু অংশের চুল মুণ্ডন করে বাকি অংশে চুল রেখে দেয়া থেকে বিরত থাকা কর্তব্য; আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ মাথার চুলের কিছু অংশ মুণ্ডন করে কিছু অংশে চুল রাখতে নিষেধ করেছেন।
অনুরূপভাবে সে তার দাড়িতে কালো রঙ ব্যবহার থেকে বিরত থাকবে; এরশাদ হয়েছে, যখন আবূ বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু’র পিতাকে মক্কা বিজয়ের দিন নবী ﷺ এর নিকট নিয়ে আসা হল এবং সে অবস্থায় তার মাথা ছিল ধবধবে সাদা, তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: তোমরা তাকে কারও কাছে নিয়ে যাও এবং সে যেন কোনো কিছু দিয়ে তার মাথার চুলকে বদলিয়ে দেয়; আর তোমরা কালো রঙ পরিহার কর। মেহেদী ও ‘কাতাম’ নামক উদ্ভিদ দ্বারা খেযাব দেয়া উত্তম। মুসলিম ব্যক্তি যদি তার মাথার চুল লম্বা করে রাখে এবং তা মুণ্ডন না করে, তাহলে তেল দিয়ে ও বিন্যাস করার মাধ্যমে তার যত্ন নিবে; রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
مَنْ كَانَ لَهُ شَعْرٌ فَلْيُكْرِمْهُ
যে ব্যক্তির চুল আছে, সে যেন তার যত্ন করে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস-৪১৬৩
৩. নাভীর নিচের পশম ছেঁচে ফেলাঃ নাভীর নিচের অবাঞ্ছিত পশম, নখ ইত্যাদি বিনা ওজরে চল্লিশ দিন পর কাটা মাকরূহ তাহরীমি বা গোনাহেরর কাজ। এ বিষয়ে হযরত আনাস রাযি. বলেন,
وُقِّتَ لَنَا فِي قَصِّ الشَّارِبِ، وَتَقْلِيمِ الأَظْفَارِ، وَنَتْفِ الإِبِطِ، وَحَلْقِ الْعَانَةِ، أَنْ لاَ نَتْرُكَ أَكْثَرَ مِنْ أَرْبَعِينَ يَوْماً
অর্থাৎ, গোঁফ ছোট রাখা, নখ কাঁটা, বগলের পশম উপড়িয়ে ফেলা এবং নাভীর নিচের পশম চেঁছে ফেলার জন্যে আমাদেরকে সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল যেন, আমরা তা করতে চল্লিশ দিনের অধিক দেরী না করি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস-২৫৮
নাভীর নিচের অবাঞ্ছিত পশমের সীমানা হলো, পায়ের পাতার উপর ভর করে বসা অবস্থায় নাভী থেকে চার পাঁচ আঙ্গুল পরিমাণ নিচে যে ভাঁজ বা রেখা সৃষ্টি হয় সেখান থেকেই অবাঞ্ছিত পশমের সীমানা শুরু। ঐ ভাঁজ থেকে দুই উরু পর্যন্ত ডান-বামের পশম, লজ্জাস্থানের চতুর্পার্শের, অণ্ডকোষ থেকে মলদ্বার পর্যন্ত উদগত পশম এবং প্রয়োজনে মলদ্বারের আশ-পাশের পশম অবাঞ্ছিত পশমের অন্তর্ভুক্ত। -আল মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা কুয়েতিয়্যা ৩/২১৬-২১৭
পুরুষের জন্য চেঁছে ফেলা এবং মহিলাদের জন্য উপড়িয়ে ফেলা মুস্তাহাব। -কিতাবুল ফিকহ আ’লাল মাযাহিবিল আরবাআ’ ২/৪৫
ব্লেড, ক্ষুর বা কাঁচি দ্বারা নাভীর নিচের পশম পরিস্কার করা পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য জায়েয। অনুরূপভাবে লোমনাশক ঔষধ দ্বারা পরিস্কার করাতেও শরীয়তের কোন বাধা নেই। কেউ যদি কাঁচি দ্বারা ছোট করে রাখে, তাহলে তাও জায়েয হবে, তবে উত্তম হবে না।
৪. বগলের পশম উপড়ে ফেলাঃ সুতরাং মুসলিম ব্যক্তি তার উভয় বগলের পশম উপড়ে ফেলবে; আর যদি বগলের পশম উপড়ানো সম্ভব না হয়, তাহলে তা মুণ্ডন করে ফেলবে অথবা তাতে লোমনাশক ঔষধ বা অনুরূপ কিছু দিয়ে প্রলেপ দিবে, যাতে তা পরিষ্কার হয়ে যায়।
৫. নখ কাটা, সুতরাং মুসলিম ব্যক্তি তার নখসমূহ কেটে ফেলবে; আর নখ কাটার ক্ষেত্রে তার জন্য মুস্তাহাব হল ডান হাত দিয়ে শুরু করা, তারপর বাম হাত, অতঃপর ডান পা ও বাম পা। কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ যেকোন কাজ ডান দিক থেকে শুরু করতে পছন্দ করতেন।
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: إِنْ كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَيُحِبُّ التَّيَمُّنَ فِي طُهُورِهِ إِذَا تَطَهَّرَ، وَفِي تَرَجُّلِهِ، إِذَا تَرَجَّلَ، وَفِي انْتِعَالِهِ إِذَا انْتَعَلَ
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুলাহ ﷺ ওযূ-গোসলের পবিত্রতা অর্জনের সময়, চুল আঁচড়ানোর সময় এবং জুতা পরার সময় ডান দিক থেকে শুরু করতে ভালবাসতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস-২৬৮
মুসলিম ব্যক্তি এসব কিছু করবে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আনুগত্য ও অনুসরণ করার নিয়তে, যাতে সে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আনুগত্য ও তাঁর সুন্নাতের অনুসরণ করার সাওয়াব অর্জন করতে পারে; কারণ, কর্মের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই বরাদ্দ থাকবে, যা সে নিয়ত করে।
আল্লাহ তায়ালা আমল করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : ইমাম ও খতিব
কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য, আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন, খুলনা।