আগামী ২৫ জুন ২০২২ বাংলাদেশের উন্নয়ন ইতিহাসে স্মরণীয় দিন। কারণ ঐদিন এদেশের মানুষের বহুদিনের লালায়িত স্বপ্নের পদ্মা বহুমূখী সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। সেতুটি নির্মাণের মাধ্যমে দেশের রাজধানী ও পূর্বাঞ্চলের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিামাঞ্চলের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২১.৫ মিটার। সে হিসেবে এটি দেশের সর্ববৃহৎ ও বিশ্বে ১২২তম। দুই স্তরবিশিষ্ট এই সেতুতে উর্ধ্বস্তরে রয়েছে চারলেনের মহাসড়ক এবং নিম্নস্তরে এক লেনের রেলপথ। সেতুটির মাওয়া প্রান্তে ২.৩ কিলোমিটার এবং জাজিরা প্রান্তে ১২.৮ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।
এডিপির হিসেব মতে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দেশের মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মানুষ বসবাস করে। সেতুটি নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ২১টি জেলার প্রায় ৩ কোটি মানুষ উপকৃত হবে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এ সেতুর দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে।
সেতুটি নির্মাণের ফলে দেশে এর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর কী প্রভাব পড়বে, এ বিষয়ে সেতুর ডিজাইন পরামর্শক মনসেল-এইকম ২০১০ সালে এক সম্ভাব্য সমীক্ষায় সেতুর বেনিফিট-কস্ট রেশিও (বিসিআর) ১.৭ এবং ইকোনমিক ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন (ইআইআরআর) ১৮ শতাংশ উল্লেখ করে। এর সাথে নির্মাণ ব্যয় যুক্ত হয়ে বিসিআর ২.১ এবং ইআইআরআর দাঁড়াবে ২২ শতাংশে। এর অর্থ পরিস্কার যে, সেতুটি স্থাপন অর্থনৈতিক বিবেচনায় লাভজনক। সেতুটি চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানী শহরের দূরত্ব গড়ে ২ থেকে ৪ ঘণ্টা কমবে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, সেতুটি উদ্বোধনের পর অসংখ্য যানবাহন ফেরি সার্ভিস থেকে এই সেতুতে স্থানান্তরিত হবে। নিচের সারণিতে খুলনা ও যশোর থেকে রাজধানী ঢাকাতে ভ্রমনকাল ও দূরত্ব সাশ্রয়ের একটি হিসাব তুলে ধরা হলো :
ঢাকার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ সহজ হওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সকল পেশা ও শ্রেণির মানুষ উপকার পাবে। এ অঞ্চলে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়বে, কাঁচামাল সরবরাহ সহজলভ্য ও শিল্পায়ন-নগরায়নের প্রসার ঘটবে এবং কৃষির উন্নয়ন ঘটবে। বিশেষ করে শরিয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুর জেলাসহ অন্যান্য জেলায় উৎপন্ন কৃষিপণ্য সরাসরি ঢাকাতে চলে যাবে। এতে করে স্থানীয় কৃষকরা পণ্যের সঠিক মূল্য পাবে বলে কৃষিবিদরা মনে করেন। বিশ্বব্যাংক ও সেতু বিভাগ নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা প্রতিবেদনে সেতু নির্মাণের ফলে অর্থনৈতিক প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের বার্ষিক জিডিপি ২ শতাংশ এবং দেশের সার্বিক জিডিপি ১ শতাংশের অধিক হারে বাড়বে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড আবর্তিত হয়। এ সেতু নির্মাণের ফলে দেশের সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোর উন্নতি ঘটবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে এ দেশের সংযোগ স্থাপিত হবে। ফলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।
বর্তমানে পদ্মা নদী পার হয়ে ১৫ হাজার যানবাহন নিয়মিত চলাচল করে। এডিবির হিসেব অনুযায়ী সেতুটি চালু হলে ২০২৪ সাল নাগাদ ২৪ হাজার এবং ২০৫০ সালে ৬৭ হাজার যানবাহন চলবে। অর্থাৎ যানবাহন দ্বিগুণ হবে এবং প্রতি বছর যানবাহন সংখ্যা ৭-৮ শতাংশ হারে বেড়ে যাবে। বিবিসির মতে, পদ্মা সেতুতে যানবাহন সংখ্যা বাড়বে ২০গুণ। সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে নতুন ধারার সুযোগ তৈরি হবে। এছাড়া দেশে গ্যাস, বিদ্যু ও ইন্টারনেট সার্ভিস মুল্য কমে আসবে।
পদ্মা নদীর উভয় পাড়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল, ইপিজেড, হাইটেক পার্ক ও প্রাইভেট শিল্পনগরী গড়ে উঠবে। উৎপাদন, বিনিয়োগ বাড়বে এবং বাড়বে মানুষের নানামুখী কর্মসংস্থান। ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে দারিদ্র বিমোচনের পথ সুগম হবে। এছাড়া ওই এলাকার তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ যারা কখনো ঢাকামুখী হয়নি, বিশেষ করে নদীর কারণে যারা ঢাকা যাওয়াতে ভয় পেত তারাও এবার ঢাকা যাবার সাহস পাবে। এতে করে মানুষের মধ্যে যে বদ্ধ গতিশীলতা ক্রিয়াশীল তার অনেকখানি পরিবর্তন হবে। এছাড়া উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর আরো সচল হবে।
বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশ বৈদেশিক বাণিজ্য চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। সেতুটি চালু হলে স্বল্প সময়ে বন্দর থেকে মালামাল ঢাকা পৌছাবে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের উপর বাড়তি চাপ অনেকখানি কমে আসবে। পাশাপাশি এ অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। বিশেষ করে সাগরকন্যা কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, ভরতভায়না, ষাটগম্বুজ মসজিদ, খানজাহান আলীর মাজার, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মাজার, মাওয়া ও জাজিরা পাড়ের রিসোর্টসহ নতুন পুরানো পর্যটনকেন্দ্র দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হবে। এক্ষেত্রে কুয়াকাটা ও সুন্দরবনসংলগ্ন ছোট ছোট দ্বীপগুলো মালদ্বীপের মতো পর্যটন-উপযোগী হতে পারে।
এছাড়া পৃথিবীর চারটি উত্তর-দক্ষিণ রেখা এবং তিনটি পূর্ব-পশ্চিম রেখা ভৌগোলিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ১২টি জায়গায় ছেদ করেছে তার একটি পড়েছে বাংলাদেশের ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায়। সহজ কথায় কর্কট ক্রান্তি এবং ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার ছেদবিন্দুটি পড়েছে এখানে। সম্প্রতি সেটি আবিস্কৃত হয়েছে। ঠিক সেখানেই বঙ্গবন্ধুর নামে মানমন্দির নির্মাণের প্রস্তাব উঠেছে। মানমন্দিরটি নির্মিত হলে তা হয়ে উঠবে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। ফলে অভ্যন্তরীন পর্যটকসহ সারাবিশ্ব থেকে মানুষ আসবে ভৌগোলিক এ গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি দেখতে। এক্ষেত্রে পদ্মা সেতু অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে। ফলে কৃষিনির্ভর এই অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের ব্যাপক উন্নয়ন হবে, বদলে যাবে জীবনধারা। ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসার ঘটার পাশাপাশি কয়েকগুণে বৃদ্ধি পাবে জমির দাম, যার সুফল ভোগ করবে এই এলাকার সাধারণ মানুষ।
অর্থনীতিবিদদের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্বাস যে পদ্মা সেতু চালু হলে মানুষের আয়-রোজগার আগের তুলনায় বাড়বে। ফলে দেশের সার্বিক দারিদ্র্য সূচক কমবে। এক কথায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ দেশের মানুষের সার্বিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য বাড়বে, মানব উন্নয়ন সূচকের অগ্রগতি ঘটবে। যানবাহনের টোল থেকে অর্জিত আয়ও এ প্রবৃদ্ধিতে যুক্ত হবে।
এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর ৭ লাখ বাংলাদেশি শুধু চিকিৎসার জন্য বিদেশে গমন করে। এদের অধিকাংশই ভারতে গমন করে। পদ্মা সেতু চালু হলে ভারতের সাথে সারাদেশের যোগাযোগ সহজ হবে। ফলে চিকিৎসাসহ নানা প্রয়োজনে এদেশের অসংখ্য মানুষ ভারতমুখী হবে। ফলে ভারতের বিশেষ করে কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্যর প্রসার ঘটবে। পাশাপাশি পদ্মা সেতু চালু হলে মাওয়া-শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া-আরিচা ঘাটের ফেরি, লঞ্চ, স্পিডবোড ও নৌকার সাথে সম্পৃক্ত অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। এত করে তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা চলে আসবে। বিশেষ করে ঘাট সংলগ্ন নদীর দুতীরে গড়ে ওঠা ব্যবসা বাণিজ্যের (মুদি দোকান, স্টেশনারি, হোটেল) সাথে যুক্ত প্রায় লক্ষাধিক মানুষ নিজ নিজ পেশা হারিয়ে বেকার হয়ে পড়বে। তাদের জন্য বিকল্প কাজের ব্যবস্থা তৈরি করতে না পারলে, সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে।
মোট কথা এই সেতুকে কেন্দ্র করে দেশে প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সেতুটি চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক পরিচয় অনেকখানি পাল্টে যাবে। মানুষের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে এবং সামাজিক গতিশীলতা বাড়বে নিঃসন্দেহে। নদীর কারণে দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতাবোধের সৃষ্ট হয়, তার অবসান ঘটবে আশাকরি।
(লেখক : সমাজ গবেষক ও শিক্ষক, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর)
খুলনা গেজেট/ এস আই