খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকরে যেসব ঝুঁকি আমাদের একেবারেই অজানা

লাইফ স্টাইল ডেস্ক

হৃদরোগের মূল ঝুঁকিগুলো হলো উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, অতিরিক্ত কোলেস্টেরল এবং দেহের অতিরিক্ত ওজন। এসব কথা বেশিরভাগ মানুষেরই জানা। তবে এমন অনেক লোকের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, যাদের এসব সমস্যার কোনোটিই ছিল না।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, গাউট বা গেঁটে-বাত, সোরিয়াসিস, অন্ত্রের প্রদাহ এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসও হৃদরোগের ঝুঁকির কারণ। এসব সমস্যার মধ্যে প্রধান মিল হলো দেহে দীর্ঘস্থায়ী ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহ।

ইদানিং কিছু গবেষক কার্ডিওভাসকুলার রোগকে ধমনীর দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত রোগের কাতারে ফেলছেন।

বিজ্ঞানীরা কখনও কখনও একে ‘এথেরোস্ক্লেরোটিক কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের (এএসসিভিডি)’ প্রদাহজনক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন।

যে প্রক্রিয়ায় প্রদাহ ঘটে

ধমনীর দেয়ালে চর্বির স্তর জমতে শুরু করলে এথেরোস্ক্লেরোসিস ঘটে। এতে ধমনী শক্ত হয়ে যায়। হৃৎপিণ্ডে অক্সিজেনসহ রক্ত সরবরাহকারী ধমনীতে এমনটি ঘটে। একে বলা হয় করোনারি আর্টারি ডিজিজ।

হৃদপিণ্ডে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ না হলে এএসসিভিডি হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এতে ইস্কেমিক স্ট্রোকও হতে পারে। কারণ পর্যাপ্ত রক্ত মস্তিষ্কে পৌঁছায় না। কেন এএসসিভিডি ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহজনক সমস্যা তা বুঝতে প্রথমে জানতে হবে কীভাবে প্রক্রিয়াটি শুরু হয়।

এথেরোস্ক্লেরোসিস হওয়ার প্রথম পর্যায়ে কোষের একটি স্তর যা ধমনীর দেয়াল হিসেবে কাজ করে। সেই এন্ডোথেলিয়ামে কোনও ক্ষত তৈরি হয়। যাকে ‘খারাপ কোলেস্টেরল’ বলা হয়। সেই উচ্চ মাত্রার লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন বা এলডিএল কোলেস্টেরলের কারণে এটি ঘটতে পারে।

সিগারেটের ধোঁয়ার বিষাক্ত পদার্থ ধমনীর আস্তরণে চুলকানি তৈরি করে। ফলে ধমনীর দেয়ালে ক্ষত তৈরি হয়।এন্ডোথেলিয়াল কোষ আহত হলে রাসায়নিক বার্তা পাঠিয়ে রক্তের শ্বেত রক্তকণিকাকে ডেকে আনে। এই শ্বেতকণিকা দেহের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এসব ধমনীর দেয়ালে ঢুকে পড়ে এবং তাতে প্রদাহ তৈরি করে।

একইসঙ্গে শ্বেত রক্তকণিকা ধমনীর দেয়ালে লেগে থাকা কোলেস্টেরলও খেয়ে ফেলে। যার মাধ্যমে ধমনীর দেয়ালে ‘ফ্যাটি স্ট্রিক’ বা চর্বির দাগ তৈরি হয়। এথেরোস্ক্লেরোসিসের প্রথম দৃশ্যমান লক্ষণগুলোর মধ্যে যা অন্যতম।

ধমনীতে ফ্যাটি স্ট্রিক তৈরি হতে শুরু করে অল্প বয়স থেকেই। আমাদের বয়স বিশের কোঠায় পৌঁছালে বেশিরভাগের ধমনীতেই ফ্যাটি স্ট্রিকের প্রমাণ পাওয়া যায়। ধমনীর এন্ডোথেলিয়াল কোষের ক্ষতি, সেখানে শ্বেত রক্তকণিকার অনুপ্রবেশ এবং প্রদাহের প্রক্রিয়াটি বছরের পর বছর ধরে সংগোপনে ঘটতে পারে। ফলে শেষ পর্যন্ত ধমনীতে প্লেক তৈরি শুরু হয়।

এর মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা যায়, দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনক অবস্থায় থাকা মানুষ কেন কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকিতে পড়েন। হৃদপিণ্ড ও মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীতে দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ শেষে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের দিকে চলে যায়।

নীরব প্রদাহ

হৃৎপিণ্ডের সরবরাহকারী ধমনীতে প্লেকের স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে হার্ট অ্যাটাক হয়। এতে প্লেকটি ফেটে যেতে পারে। ফলে ধমনীতে রক্ত বা অন্য কোনও বস্তু জমাট বাঁধতে পারে। হৃৎপিণ্ডের পেশীতে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হয়। যাদের হার্ট অ্যাটাক হয়, প্রায়শই ঘটনার দিন কিংবা আগের সপ্তাহে তাদের ধমনীতে প্রদাহ এবং প্লেকের অস্থিরতার মাত্রা বেড়ে যায়।

চূড়ান্ত ‘হার্ট অ্যাটাক’ এবং এর ফলে হৃদপিণ্ডের পেশীর ক্ষতি হওয়ার কারণ হলো এই অস্থির প্রদাহজনক প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এই দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনক প্রক্রিয়া কোনও লক্ষণ ছাড়াই ঘটতে পারে। যেসব রোগীর হৃদরোগের পরিচিত ঝুঁকি নেই তারা বুঝতেই পারবেন না তাদের অন্য ঝুঁকিগুলো বেড়ে গেছে।

যেভাবে প্রদাহ পরিমাপ করা যায়

সুসংবাদ হলো শরীরে প্রদাহ পরিমাপ করার উপায় আছে। সেটি হলো উচ্চ-সংবেদনশীলতার সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন (এইচএস-সিআরপি) নামক রক্ত পরীক্ষা। উঁচু মাত্রার এইচএস-সিআরপি স্তরের লোকদের হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। উঁচু মাত্রার এলডিএল কোলেস্টেরলও এএসসিভিডি-র ঝুঁকির কারণ।

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, যেসব মানুষের উচ্চমাত্রার এলডিএল কোলেস্টেরল এবং এইচএসএস-সিআরপি রয়েছে, তাদের কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

প্রদাহ কমাতে নানা গবেষণা

ক্যান্টোস নামের বড় ধরনের ক্লিনিকাল ট্রায়ালে উঁচু মাত্রার এইচএস-সিআরপি রয়েছে। হার্ট অ্যাটাকের পর এমন রোগীর ওপর ক্যানাকিনুম্যাব নামের প্রদাহবিরোধী ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এতে দেখা যায়, ওই অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগের ব্যবহারে এইচএস-সিআরপি-র মাত্রা কমেছে। রোগীর হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যাও ছোট। পরিসংখ্যানগতভাবে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

তবে ওই ওষুধ যারা ব্যবহার করেন, তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়েছে। তবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় শিগগিরই এএসসি’ডি-র চিকিৎসায় ক্যানাকিনুম্যাব ব্যবহারের সম্ভাবনা নেই। যাহোক, গবেষণাটি যুগান্তকারী হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।

কারণ এর মাধ্যমেই প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল, এএসসিভিডিতে প্রদাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেই প্রদাহকে কমিয়ে আনতে পারলে তা কার্ডিওভাসকুলার ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে। এএসসিভিডি’র ঝুঁকির কারণ সম্পর্কে যেভাবে চিন্তা করা হয়, তাতে পরিবর্তন ঘটাতে পারলে হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোকের ঝুঁকিতে থাকা রোগীকে আরও ভালোভাবে শনাক্ত করা যাবে।

এর মাধ্যমে কার্ডিওভাসকুলার ঝুঁকি কমাতে প্রদাহের চিকিৎসার দিকে বেশি নজর দেয়া যাবে। ইতোমধ্যে কিছু গবেষণায় প্রদাহ কমাতে এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের বৃদ্ধি রোধে কোলচিসিন ও মেথোট্রেক্সেটের মতো সস্তা প্রদাহবিরোধী ওষুধের ব্যবহারের দিকে নজর দেয়া হচ্ছে।

প্রদাহ কমাতে জীবনধারায় পরিবর্তন

খুশির বিষয় হলো, ওষুধের ওপর নির্ভর না করেই শরীরে প্রদাহ কমানো সম্ভব। জীবনে যা কিছু করা যায়, একে প্রদাহ-পন্থী বা প্রদাহবিরোধী বলে শেয়ার করা যায়। ধূমপান প্রদাহজনক কারণ সিগারেটের টক্সিন শরীরে জ্বালা বাড়ায়। রক্তে উঁচু মাত্রার কোলেস্টেরল এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার ধমনীতে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের কারণ হতে পারে।

ফল শাকসবজি, দানাদার শস্য এবং তৈলাক্ত মাছ প্রদাহ-বিরোধী। নিয়মিত ব্যায়াম শরীরে প্রদাহের মাত্রাও কামিয়ে আনতে পারে। স্থূলতা, বিশেষ করে কোমরের চারপাশে অতিরিক্ত ওজন দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের কারণ। ভুঁড়ি কমাতে পারলে প্রদাহও কমে।

স্ট্রেস বা মানসিক চাপ শরীরে দীর্ঘস্থায়ী ও নিচু মাত্রার প্রদাহ তৈরি করতে পারে। স্ট্রেস কমানোর চেষ্টা জরুরি। রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখা, কোলেস্টেরল ও বডি মাস ইনডেক্স ঠিক রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রদাহ-বিরোধী বিকল্প পথ বেছে নেয়ার মাধ্যমে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে সবাই হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারি। আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারি।

খুলনা গেজেট/ এএজে




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!