খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৫শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর স্থগিত
  কাতারের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে নতুন বাংলাদেশ গড়তে আর্থিক ও বিনিয়োগের সহায়তা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস

সৌরভের গৌরবের খুলনা

কাজী মোতাহার রহমান

খুলনা। পীর খানজাহানের স্নেহধন্য। শিল্প ও বন্দর নগরী। বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ, সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হক, রাজনীতিক আব্দুস সবুর খান, কেডি ঘোষ, ঐতিহাসিক অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র মিত্র, ব্রজলাল চক্রবর্তী, কবি কৃষ্ণ মোহন মজুমদার, রায় বাহাদুর মহেন্দ্র কুমার ঘোষ, রায় বাহাদুর বিনোদ বিহারী সাধু, আব্দুল হাকিম, মোস্তা গাউসুল হক, এ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার, এ এফ এম আব্দুল জলীল, এ্যাডভোকেট এ এইচ দেলদার আহমেদ, সালাহউদ্দিন ইউসুফ, আইন বিশেষজ্ঞ শামসুর রহমান, শেখ আব্দুল আজিজ, এম, মুনসুর আলী, এডভোকেট মমিন উদ্দীন আহমেদ, এম এ গফুর, আবু মহম্মদ ফেরদৌস, ঐতিহাসিক ডঃ শেখ গাউস মিয়া, ভাষা সংগ্রামী আনোয়ার হোসেন, ৬৯ এর শহীদ হাদিসুর রহমান, আলতাফ হোসেন, প্রদীপ, ৯০ এর শহীদ মহারাজ সরদার, ২০২৪ এর শহীদ শেখ মো. সাকিব রায়হান, আব্দুল হামিদ শেখ, ইয়াসিন শেখ, রকিবুল হাসান গাজী, নূরনবী মোড়ল, ফুটবল খেলোয়াড় শেখ আসলাম ও আব্দুস সালাম মুর্শেদীর জন্মস্থান। খুলনা সুন্দরী সুন্দরবনের পদদেশে অবস্থিত। মংলা সমুদ্র বন্দরের সন্নিকটে। শিপইয়ার্ড, নিউজপ্রিন্ট, হার্ডবোর্ড কেবল শিল্প ফ্যাক্টরী, হিমায়িত খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, পাটকলসহ অসংখ্য শিল্পের নগরী খুলনা। এ দেশের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সুতিকাগার।

পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার একদিন পরে যথাক্রমে খুলনায় চাঁদতারা খচিত এবং গাঢ় সবুজের মাঝে লাল সূর্যে আঁকা স্বাধীনতার পতাকা ওড়ে। এসব কারণে খুলনা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। নামকরণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যেও মতভেদ আছে। এ নামের সাথে জড়িয়ে আছে অসংখ্য আজগুবী কিংবদন্তী আর প্রবাদ। ১৯৮৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত “শতবর্ষে খুলনা পৌরসভা” স্মরণিকায় শেখ শাহজাহান রচিত খুলনা নামকরণ প্রসঙ্গে এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন জনৈক অধ্যাপক বলেছেন, তুর্কি রাজত্বের প্রথম দিকে সাগর পথে আরব নাবিকেরা এখানে প্রবেশ করে বলত “আদ খোলনা” অর্থাৎ আমরা প্রবেশ করলাম।

আরবী আদ খোলনার অংশ খোলনা থেকে খুলনা নামকরণ হয়েছে। আসলে আদ খোলনা বলে কোন আরবী শব্দ নেই। আদ খালনা বলে একটি শব্দ আছে যার অর্থ আমরা প্রবেশ করাইলাম। আমরা প্রবেশ করলাম আর আরবী শব্দের “আদখোলনা” খুলনার সাথে কোন মিল নেই। এটি একটি মনগড়া প্রবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। দ্বিতীয় প্রবাদ রয়েছে যে, খুলনা নগরীর বর্তমান স্থান সুন্দরবন ছিল। বনের উত্তর প্রান্তে কাঠুরিয়ারা ঝড় তুফানের সময় নৌকা নোঙ্গর করত। বনে থাকতেন বন দেবী। এক সময় ঝড় উঠলেই মাঝিরা নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য নৌকা খোলার উদ্যোগ নিলে বনের ভেতর থেকে গায়েবী আওয়াজ হত “খুলোনা, খুলোনা”। এই খুলোনা থেকে খুলনা নামের উৎপত্তি।

ঐতিহাসিক অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র মিত্র ও ঐতিহাসিক এ এফ এম আব্দুল জলীলের মতে তুর্ক-আফগান রাজত্বের প্রারম্ভ থেকে নগরীর পূর্বপাড়ে “কিসমত খুলনা” নামে ছোট একটি গ্রাম ছিল। এটি এখন রূপসা উপজেলার সীমানায়। ঐ নামে এখনও একটি মৌজা রয়েছে। এখানে সর্বপ্রথম থানা, পরে মহাকুমা, এক পর্যায়ে জেলা, পরবর্তীতে বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। এই কিসমত খুলনা গ্রামের নাম থেকে মহাকুমা ও জেলার নাম হয়েছে খুলনা। খুলনা জেলা গ্রন্থের লেখক, সাবেক জেলা প্রশাসক মরহুম মো. নুরুল ইসলাম ও খুলনা শহরের ইতিকথা গ্রন্থের লেখক মরহুম মীর আমীর আলী এ মতটি সমর্থন দিয়েছেন। কিসমত খুলনা নামটি সেটেলমেন্টের জরীপ ভুক্ত। কবি কংকন বিরোচিত চন্ডী কাব্যের নায়ক ধনপতি সওদাগার নিজের জাহাজে পণ্য বোঝাই করে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসগর পাড়ি দিয়ে সিংহলে বাণিজ্য করতে যেতেন। ধনপতি সওদাগর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার অজয় নদের তীরে পুজানী নগরের অধিবাসী। তিনি ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য এখানে আসতেন। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচল করত তার বাণিজ্য নৌবহর। ধনপতি সওদাগরের দু’স্ত্রী। প্রথম জনের নাম লহনা, দ্বিতীয় জনের নাম খুল্লনা। ধনপতি সওদাগরের দ্বিতীয় স্ত্রীর নামানুসারে এই স্থানের নামকরণ খুল্লনা। সেই থেকে খুলনা নামের উৎপত্তি। ঐতিহাসিক অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র মিত্র এবং মো. তোহা খান এ মতের সমর্থক। পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি বাণিজ্য কেন্দ্রের পাশে মুনির আশ্রম ও মন্দির ছিল। ধনপতি সওদাগর এ মন্দিরে এসে পূজা দিতেন। কপিলমুনি বাণিজ্য কেন্দ্রের উত্তর-পূর্বদিকে তালিমপুর ও শ্রীরামপুরের মধ্যবর্তী এলাকার বন বাদাড় পরিস্কার করে ধনপতি সওদাগর বসতবাড়ি গড়ে তোলেন।

তার দ্বিতীয় স্ত্রীর নামানুসারে এ স্থানটির নামকরণ করা হয় খুল্লনা। ধনপতি তার দ্বিতীয় স্ত্রী নামানুসারে খুল্লনাশ্বরী মন্দির স্থাপন করেন। এতে প্রথম স্ত্রী লহনা ক্ষুব্দ হয়ে উঠেন। প্রথম স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে যেয়ে ধনপতি সওদাগার ভৈরব নদের তীরে উত্তর পাশে লহনেশ্বরী মন্দির ও দেবী মুতি স্থাপন করেন। দু’স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক গাঢ় করার লক্ষে সওদাগর কপিলমুনি বাণিজ্য কেন্দ্রের পাশে “লহনা-খুল্লনা” নামে একটি পুল নির্মাণ করেন। ইংরেজ আমলে রেকর্ড ও মানচিত্রে এ স্থানের নাম “কুলনা” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইংরেজ রেনেলের ডায়রীতে এই স্থানটিকে “কুলনা’ বলা হয়েছে। এটা ইংরেজদের উচ্চারণজনিত সমস্যা। ১৭৬৬ সালে ফল মাউথ নামক একটি জাহাজের নাবিকের রেকর্ড থেকে প্রাপ্ত রেকর্ডে উল্লেখ আছে এখানকার নাম কুলনিয়া। এই কুলনিয়া শব্দ থেকে বর্তমান খুলনা নামের উৎপত্তি। ইংরেজ আমলে যশোর-খুলনা মানচিত্রে ইংরেজীতে ঔঊঝঝঙজঊ- ঈটখঘঅ লেখা হত।

প্রশাসনিক কাঠামো: ১৮৩৬ সালে রূপসা নদীর পূর্ব তীরে তালিমপুর-রহিমনগরের সন্নিকটে কিসমত খুলনা মৌজায় নয়াবাদ নামে একটি থানা স্থাপন করা হয়। তৎকালীন সরকার সুন্দরবনের একটি অংশ সাফ করে এ থানা স্থাপন করেন। নয়াবাদ থানা স্থাপনের পূর্বে এ অঞ্চলের থানা ছিল যশোর জেলা সদরের মুড়ুলী। নতুন আবাদ করে থানা- সূচনা করা হয় বলে নামকরণ করা হয় নয়াবাদ বা নত্তাবাদ। ১৯২৫ সালে দৌলতপুরের মোহাম্মদ হানিফ রিয়াজউদ্দিন শেখ-এর দেওয়ালের নীচে প্রাপ্ত পিতলের একটি চৌকিদারী চাপরাশ থেকে জানা যায় ১৮৩৬ সালে এখানে থানার জন্ম হয়। এ অঞ্চলের অধিকাংশ মৌজা ও গ্রামগুলি ছিল চব্বিশ পরগনা ও যশোর জেলার অধীনে। আইন-ই-আকবর থেকে জানা যায়, যশোরের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ এবং খুলনার উত্তরাংশ খলিফাতাবাদের অধীনে ছিল। চব্বিশ পরগনা থেকে পৃথক করে যশোর জেলার সৃষ্টি হয়।

১৮৪২ সালে খুলনা মহকুমার যাত্রা শুরু হয়। এটি দেশের প্রথম মহকুমা। নয়াবাদের সন্নিকটেই এ মহকুমার অফিস স্থাপিত হয়। মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন মিঃ এম এ জি শো। তার প্রথম অফিস শুরু হয় থানা এলাকার একটি তাবুতে। উইলিয়াম রেনী নামে একজন নীলকর ইংরেজ শাসন আমলের প্রথম দিক থেকে এখানে বসবাস করতেন। তিনি অত্যাচারী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেন। এখানে মহাকুমার ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস হওয়ায় উইলিয়াম রেনী অস্বস্তিবোধ করেন। তার পরামর্শে রূপসা ও ভৈরব নদের মিলনস্থলের পাশে মির্জাপুর মাঠের উত্তরে উচু স্থানে মহকুমা সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। স্থানটি আজকের জেলা প্রশাসকের বাসভবন। এই স্থানটি এক সময় মির্জাপুরের মাঠ বলে পরিচিত ছিল। ১৮৮২ সালে খুলনা জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সাতক্ষীরা, নড়াইল, খুলনা ও বশিরহাট মহকুমার অংশ নিয়ে খুলনা জেলার যাত্রা। ১৮৮২ সালের ২৫ এপ্রিল খুলনা জেলার গেজেট নেটিফিকেশন হয়। ১ জুন থেকে জেলার কার্যক্রম শুরু হয়।

১৮৮১ সালের ২ মে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দি স্টেটসম্যান নামক পত্রিকার এক খবরে বলা হয় “New District: From the Isntant the much Talked New District formed of the Sub-division of Satkhira, Norail, Khulna and part of the Bashirhat has been Organised at Head quarters of the Sub- division bearing the name of the disrtict. The district is a third class having one. a district Magistrate and Collector at its head of affairs. The Chief civil authority for the time Bing is a Subbordinate. The civil and Sessions judge of Jessore. It has been arrnged will hold Sessions form time the Head quarters”

১৮৪২ সালে খুলনা সদর, ১৮৬১ সালে সাতক্ষীরা এবং ১৮৬৩ সালে বাগেরহাট মহাকুমার সৃষ্টি হয়। ঐ সময় খুলনা জেলার আয়তন ছিল ৪ হাজার ৬শ’ ৩০ বর্গমাইল। লোক সংখ্যা ৪৩ হাজার ৫শ’। খুলনার প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মিঃ ডাবলু এম ক্লে। তার নামানুসারে বড় বাজার থেকে ডাকবাংলা মোড় পর্যন্ত- এই রাস্তার নামকরণ করা ক্লে রোড। জেঃ এইচ এম এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৪ সালে সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

বৃটিশের বিরুদ্ধে প্রায় পৌনে দুইশ’ বছর স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কিমেন্ট এটলী ১৯৪৭ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করেন যে ৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ভারতীয় জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।

বৃটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য লর্ড ওয়াভেলের এর স্থলে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের নতুন ভাইসরয় নিযুক্ত করেন। মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়। দু’দেশের সীমানা চিহ্নিতকরণের জন্য স্যার র‌্যাডক্লিফের নেতৃত্বে একটি কমিশন নিয়োগ করা হয়। ভারতের স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত নামের স্বার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের গভর্ণর জেনারেল হলেন কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর প্রধানমন্ত্রী হলেন নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান। আমাদের প্রিয় খুলনা জেলা ভারতের মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৭সালের ৩ জুনের ঘোষণা অনুযায়ী লর্ড মাউন্টব্যাটেন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট খুলনা জেলাকে পাকিস্তানভুক্ত করেন। খুলনা-বাগেরহাটের রাজনীতিকদের মধ্যে আব্দুস সবুর খান, এস এম এ মজিদ, ডাঃ মোজম্মেল হোসেন, সৈয়দ মোস্তা গাউসুল হক, এ এফ এম আব্দুল জলীল, ডাঃ আবুল কাশেম, এ এইচ দেলদার আহমেদ, এ এইচ এম আলী হাফেজ, এস এম আমজাদ হোসেন, শেখ মোহাম্মদ আলী, আফছার উদ্দিন, আফিল উদ্দিন ও আব্দুল হালিমের প্রচেষ্টায় খুলনাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি ওঠে। এ দাবিতে ২৪ পৃষ্টা সম্বলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয় কোলকাতার ঐতিহাসিক বেলভিয়ার ভবনে ভারত ও পাকিস্তানের পক্ষে দু’গ্রুপের শুনানী হয়। স্যার – সাইরিল র‌্যাডক্লিফ ছিলেন চেয়ারম্যান। নানা যুক্তি তর্কের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যার ও বেতারে ঘোষিত হয় র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ। কলকাতা অলইন্ডিয়া রেডিও প্রচার করে খুলনা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

শিল্প কলকারখানা: সুন্দরবন ও মংলা সমুদ্র বন্দন খুলনার গর্ব। পাশাপাশি শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের দিয়ে খুলনা সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছে। ১৮৭০সাল পর্যন্ত এখানে নীল বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। লবণ ও গুড়ের জন্য খুলনার খ্যাতি ছিল। পাকিস্তানে স্বাধীনতার পর থেকে এখানে শিল্পের বিকাশ ঘটে। ১৮৮৪ সালে কলকাতা-খুলনা রেললাইন, ১৯১৭ সালে রূপসা-বাগেরহাট রেললাইন, ১৯৫০ সালের ১১ ডিসেম্বর চালনা এ্যাংকরেজ এর যাত্রা শুরু হয়। এর সেদিনের চালনা এ্যাংকরেজ আজকের মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। স্বদেশী আন্দোলনের ধারায় খুলনা শহরে ১৯৩১ সালে ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে স্থাপিত হয় খুলন এব টেক্সটাইলস মিলস। এর পূর্বের নাম ছিল আচ প্রফুল্ল চন্দ্র কটন মিল। এর পর থেকে এ পর্যন্ত-তার অঞ্চলে ৩১টি বৃহৎ শিল্প, ৬০টি মাঝারী শিল্প ও ২ স্ত্রী হাজার ক্ষুদ্র-কুঠির শিল্প গড়ে উঠে। ১৯৫৪ সাল খুলনা শিপইয়ার্ড, ১৯৬৫ সালে খুলনা হার্ডবোর্ড মিলস, ১৯৬৬ সালে লবণচরায় কোরেশী ষ্টিল মিলস্, ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশ কেবল শিল্প, ১৯৫৯ সালে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস, ১৯৫৫ সালে দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরী পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ ম্যাচ কোম্পানী, প্লাটিনাম, পিপলস, স্টার, দৌলতপুর, ক্রিসেন্ট, এ্যাজাক্স, সোনালী, মহসেন, আলিম, ইষ্টার্ণ ও আফিল জুট মিলস গড়ে উঠে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য রূপসা নদীর পূর্বপাড়ে ১৯৮০ সাল থেকে গড়ে ওঠে হিমায়িত খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- এশিয়ান, বায়োনিক, ইমন, লকপুর, বাগেরহাট, জাহানাবাদ, ন্যাশনাল, শাহনেওয়াজ, রূপালী, সৌদি, ইষ্টার্ন, ছবি, সাতক্ষীরা, সুন্দরবন, আছিয়া ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর ২০ কোটি ডলার মূল্যের হিমায়িত চিংড়ি বিদেশে রপ্তানী করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন খুলনা পৌরসভা যাত্রা শুরু হওয়ার পর চিত্তবিনোদনের জন্য পৌরসভা ভবনের বিপরীতে তৎকালীন ইটখোলার উত্তরপাশে পার্কের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে এই পার্কটি ছিল আন্দোলনকারীদের পীঠস্থান। প্রথম দিকে এর নাম ছিল মিউনিসিপ্যাল পার্ক। ১৯২৫ সালে কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধী খুলনা এসে এই পার্কে ভাষণ দেন। তারপর থেকে পার্কের নামকরণ করা হয় গান্ধী পার্ক। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর পার্কের নামকরণ করা জিন্নাহ’র নামানুসারে। আগরতলা মামলায় দেশবাসী গণ আন্দোলন গড়ে তোলে। এরই অংশ হিসেবে ১৯৬৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি হাজী মহসিন রোডে তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সৈয়দ আফজাল কাহুতের সরকারি বাসভবনের সামনে দিয়ে এক মিছিল বের হয়। ঐ বাসভবন থেকে পুলিশের গুলিতে হাদিসুর রহমান, আলতাফ হোসেন ও প্রদীপ শহীদ হয়। তারপর থেকে জিন্নাহ পার্কের পরিবর্তে এ স্থানটির নাম করা হয় শহীদ হাদিসের নামানুসারে।

মহান মুক্তিযুদ্ধ: ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের ও ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ট আসনে জয়ী হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা ইউসুফ ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের কাছে মতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে। জাতীয় পরিষদের ৩১৪টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ ২৯৮টি জয়ী হয়। খুলনা অঞ্চল থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন শেখ আব্দুল আজিজ, এম এ খায়ের, লুৎফর রহমান মনি, আব্দুল গফফার, সৈয়দ কামাল বখত সাকী, মোঃ মহসিন, সালাহউদ্দিন ইউসুফ আর প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন মীর সাখাওয়াত আলী দারু মোঃ আব্দুর রহমান, কুবের চন্দ্র বিশ্বাস, এ্যাডভোকেট মমিন উদ্দিন আহমেদ, এ্যাডভোকেট মোঃ এনায়েত আলি সানা, ডাঃ মুনসুর আলী, হাবিবুর রহমান খান, আব্দুল লতিফ খান, শেখ এনতাজ আলী, পীরজাদা আবু সাঈদ, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও ফজলুল হক। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারী রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামীলীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেঃ ইয়াহিয়া খানকে জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহবানের চাপ দেওয়া হয়। তিনি জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত করেন। ২৩ মার্চ স্থানীয় শহীদ হাদিস পার্কে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন হয়। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে গণহত্যা শুরু হয়। খুলনায় পর্যায়ক্রমে শিরোমনি, খালিশপুর, মুন্সিবাড়ী, রংপুর, পাটকেলঘাটা, বটিয়াঘাটা, চুকনগর, দুজ্জর্নীমহল ও চিতলমারীতে গণহত্যা চলে। প্রতিরোধ যুদ্ধ হয় ফুলবাড়ীগেট, দৌলতপুর ও বৈকালীতে। ২৭ মার্চের পর পূর্ব রূপসার হামিদা মঞ্জিলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প গড়ে উঠে। ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিলেন খুলনা জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজামান টুকু। ৪ এপ্রিল গল্লামারীস্থ রেডিও সেন্টার দখলের যুদ্ধে এ ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নেয়। অধিনায়ক ছিলেন চিতলমারী থানার অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর শেখ জয়নুল আবেদীন। তিনিসহ অপর দুই মুক্তিযোদ্ধর মোসলেম ও হাবিবুর রহমান শহীদ হয়। ৯ মাস যুদ্ধের পর পাকবাহিনী আত্মসমর্পন করে। ১৭ ডিসেম্বর খুলনার সার্কিট হাউজে পাকবাহিনীর স্থানীয় কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক মেজর জেনারেল দলবর সিং-এর কাছে আত্মসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর করেন। এ সময় ৯নং সেক্টরের প্রথম দিকের অধিনায়ক মেজর এম এ জলিল, শেষ দিকের অধিনায়ক মেজর জয়নাল আবেদীন ও ৮নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর আবুল মঞ্জুর উপস্থিত ছিলেন। খুলনা মুক্ত বাতাসে উড়তে থাকে স্বাধীনতার পতাকা।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!