একসময় ময়ূর নদ ছিল খুলনা শহরবাসীর জীবনের সৌন্দর্য এবং স্বস্তির প্রতীক। নদীর স্বচ্ছ পানি ও তীরে সবুজের সমারোহ স্থানীয়দের জন্য ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। শহরের প্রাণকেন্দ্র দিয়ে বয়ে যাওয়া এই নদীটি কেবল নৌযান চলাচলই নয়, কৃষিকাজ ও মৎস্যচাষের জন্যও ছিল অপরিহার্য। কিন্তু সেই সোনালি দিনগুলো এখন কেবল স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে।
গত কয়েক দশকে শিল্পায়ন ও নগরায়নের অগ্রগতির ফলে ময়ূর নদ আজ দুষণের জালে জড়িয়ে পড়েছে। নদীর পানি এখন ঘোলাটে, দুর্গন্ধময়, এবং নদীর তীরও প্লাস্টিক ও বর্জ্যে আচ্ছন্ন। শহরের বর্জ্য নদীতে ফেলে দেওয়ার ফলে নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। আর সেই বিষাক্ত পানির কারণে নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশবিদ ও নাগরিক অধিকারকর্মীরা বহুদিন ধরে নদী পুনরুদ্ধারের দাবি জানিয়ে আসছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে খুলনার একটি অভিজাত হোটেলে ময়ূর নদ সংরক্ষণে অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভায় বক্তরা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ পরিবেশে আইনবিদ সমিতি (বেলা) এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের মাধ্যমে বেলার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, নদীর দু’পাশে অবৈধ দখলকারীরা এর অংশবিশেষ ভরাট করে বসতবাড়ী পর্যন্ত তুলেছেন। পাশাপাশি অনেকে অবৈধভাবে নদটিকে খন্ড খন্ড করে বেঁধে মাছের চাষ করছেন। এছাড়াও নদীর দুপাশে অসংখ্য পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা নদীটি ব্যবহারের অযোগ্য করে তুলেছে।
উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের জন্য নদীর এই দশা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯৮২-৮৩ সালে উপকূলীয় শহর বাঁধ প্রকল্পের আওতায় খুলনা শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের পর পরই মূলতঃ এই নদের নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। একই সময়ে শহর রক্ষা বাঁধের পাশাপাশি ২৫. ২৭/১. ২৭/২ নং পোল্ডারে বাঁধ দেয়া হয়। প্রকল্পের অধীনে রায়েরমহল এলাকায় ময়ূর নদের উপর তিন গেট বিশিষ্ট একটি শ্লুইজ গেট দেয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, ১৯৮৮ সালের বন্যায় এই পরিকল্পিত এলাকা ময়ূর নদের জোয়ারে সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তথা পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে জোয়ার ও বন্যা ঠেকানোর জন্য ময়ূর নদের দক্ষিণাঞ্চলের ভৈরব-রূপসার সংযোগস্থলে বটিয়াঘাটার আলুতলায় বাঁধ দেয়া হয়। এর ফলে জোয়ারের পানি আটকে যাওয়া ময়ূর নদের দক্ষিণাংশের অংশটুকুও ধীরে ধীরে স্রোতহীন হতে শুরু করে। এভাবে বিভিন্ন সময়ে নদীকে খন্ডিত করে বিভিন্ন অপরিকল্পিত কার্যক্রমের মাধ্যমে স্রোধারাকে মৃত নালায় পরিণত করা হয়েছে।
নদী দূষণের খুলনা সিটি কর্পোরেশনকে (কেসিসি) দায়ী করে তিনি বলেন, নদটিকে মৃত নদীতে পরিণত করতে আরো সহায়ক হিসেব কাজ করেছে পাড়ের কসাইখানা ও ট্যানারীসহ শহরের দূষিতবর্জ্য। কেসিসির প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার ড্রেনের বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ে, ফলে নদীর গভীরতা পূর্বের তুলনায় অর্ধেকে এসে পৌঁছেছে। এছাড়া খুলনা সিটি কর্পোরেশন ২০০৮ সালে ময়ূর নদের পাড়ে লিনিয়ার পার্ক তৈরীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রকল্পে প্রায় ১১ কিলোমিটার নদের মাত্র দু’ কিলোমিটার নদের সংরক্ষণের কথা বলা রয়েছে। পরবর্তীতে ময়ূর নদকে বাঁচিয়ে লিনিয়ার পার্ক তৈরীর সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন ঘটেনি বরং নদকে উপেক্ষা করেই পার্ক তৈরী হয়েছিল।
ময়ূর নদ সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষের কয়েকটি উদ্যোগের সমালোচনা করে মুকুল বলেন, ২০১৪ সালের দিকে প্রায় ৫ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা ব্যয় করে ময়ূর নদ খনন করে তা কোন সুফল আনতে পারেনি। নদটি দখলমুক্তকরণে খুলনা সিটি কর্পোরেশন মাঝে মাঝে নদের অবৈধ উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে খুলনা সিটি কর্পোরেশন ও খুলনা জেলা প্রশাসনের ১৬ দিনের যৌথ অভিযানে নদ দখল করে নির্মিত ৫৮টি অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলে। তবে উদ্ধার করা হয় নদের মাত্র তিন একর জমি।
তিনি বলেন, কেসিসি নদটি সংরক্ষণে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে খুলনার জলাবদ্ধতা নিরসনে ৮৪৩ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে যার গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে ময়ূর নদ সংরক্ষণ। সংরক্ষণে দু’ পর্যায়ের একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রথম পর্যায়ে ময়ূর নদ সংলগ্ন ৯টি খাল খনন করা হবে। এবার খননের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ কোটি ৫৯ লক্ষ টাকা, যার কাজ বর্তমানে অব্যাহত রয়েছে এবং ২য় পর্যায়ে ময়ূর নদের দু’ পাড় বাঁধাই, হাঁটার রাস্তা এবং নদীকেন্দ্রিক বিনোদনের ব্যবস্থা করা হবে। পরবর্তীতে আরো ৮টি খাল সংস্কার করে সেখানে সুইজ গেট স্থাপন করা হবে এবং নদের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে ময়ূর নদের উপর তিনটি ঝুলন্ত সেতু তৈরী করা হবে।
এই প্রকল্পের আওতায় নদী খননের পাশাপাশি নদেরও দু’পাড় বাঁধাই করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা, মাঝে মাঝে দু’ পাড়ের সংযোগ সেতু করা, বিনোদনের জন্য নৌকা চালানোর ব্যবস্থা রাখা, পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। জার্মান ও নেদারল্যান্ডের দু’টি দাতা সংস্থা এবং সরকার এসব প্রকল্পে অর্থায়ন করবে। ২০২৫ সালের মধ্যে বেশীরভাগ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
বর্তমান প্রকল্পের সমালোচনা করে তিনি বলেন, তালতলা খাল খুলনার ময়ূর নদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ খাল। সম্প্রতি তালতলা খাল খনন ও দু’ পাড়ের রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে তালতলা খাল খনন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। মাঠ পরিদর্শনে দেখা গেছে, এক সময়ের ৬০ ফুট চওড়ার খালটি ১৮ ফুট চওড়ার খালে পরিণত করা হচ্ছে। একদিকে খালটি সরু করে ফেলা হয়েছে, অন্যদিকে খালটির দু’’পাশ এবং তলদেশ ঢালাই করে ফেলা হচ্ছে।
ময়ূর নদ সংরক্ষণে বেলা বিভিন্ন সময়ে আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ২০০৫ সালে ময়ূর নদের পাড়ে একটি ট্যানারী ছিল। অভিযোগের প্রেক্ষিতে লিগ্যাল নোটিশ দেয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপে তা বন্ধ হয়ে যায়। তাই রীটের প্রয়োজন হয়নি। এরপর ২০১১ সালে বেলা এলাকার সচেতন জনগোষ্ঠীর আবেদনের প্রেক্ষিতে ময়ূর নদকে দখলমুক্ত করতে হাইকোর্টে রীট পিটিশন (রীট পিটিশন নং: ১২৭৩/২০১১) দায়ের করা হয়। প্রাথমিক শুনানী শেষে হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি অবৈধ দখলকারীদের তালিকার পেশ করার আদেশ প্রদান করেন।
মত বিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন নাগরিক নেতা অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির, পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চ খুলনার সভাপতি এড. কুদরত ই খুদার সঞ্চালনায় সভায় বক্তৃতা করেন পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চের সাঃ সম্পাদক সুতপা বেদজ্ঞ, বেলার প্রোগ্রাম অফিসার এএমএম মামুন, সাংবাদিক দীপংকর রায়, এস এম মাসুম, পরিবর্তনের নাজমুল আজম ডেভিট, মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এড. মোমিনুল ইসলাম, এড. তসলিমা খাতুন ছন্দা, ছায়াবৃক্ষের মাহবুব আলম বাদশা, সাংবাদিক খলিলুর রহমান সুমন, আবুল হাসান হিমালয়, আল এহসান, ক্ষতিগ্রস্ত বেল্লাল হোসেন, আইআরভির জয় প্রমূখ।
-খবর বিজ্ঞপ্তি
খুলনা গেজেট/এএজে