খুলনা, বাংলাদেশ | ২১ পৌষ, ১৪৩১ | ৫ জানুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে এক জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৫৬

সোনামুখ প্রতিভা অন্বেষণ এবং আমার অভিজ্ঞতা

কামরুল ইসলাম

যারা সোনামুখ প্রতিভা অন্বেষণ কী তা জানেন না তাদের জন্য ছোট করে জানাচ্ছি-১৯৯২ সালে আমি যখন প্রথমবার জাতিসংঘ মিশনে কম্বোডিয়ায় কর্মরত ছিলাম, তখন দেশের সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থী ও দরিদ্র মানুষের সহায়তার জন্য আমার পিতার নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে তার নামকরণ করেছিলাম ‘ওয়াসেক আলী শিক্ষা প্রকল্প’ ও পরবর্তীতে মায়ের নামে গড়েছিলাম ‘সখিনা আলী সেবা প্রকল্প’। প্রকল্প দু’টির সার্বজনীনতার কথা চিন্তা করে পরে নামকরণ করেছিলাম ‘সোনামুখ পরিবার’। আমার বড় ভাই এ এম হারুনার রশিদ ও আমার ব্যক্তিগত অর্থায়নে এবং এলাকার কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষের দ্বারা গঠিত একটি পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নিয়ে সেই ১৯৯২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সাথে এই সংগঠন পরিচালনা করে আসছেন। আমাদের বিভিন্ন শিক্ষা ও সেবামূলক কার্যক্রমের কথা এলাকার অধিকাংশ মানুষ কমবেশি অবহিত আছেন। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম  অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষের প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকার শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। যেমন- বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা ভার্সন, ইংরেজি ভার্সন, মাদ্রাসা শিক্ষা, কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট পদ্ধতি ইত্যাদি। এসব কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারাত্মক বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।

বিভিন্ন পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্যের সাথে সাথে আরও একটি মারাত্মক বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে শহর ও গ্রাম অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এভাবে বিভিন্ন স্তরে বৈষম্য চলতে থাকলে আমাদের জাতি দিন দিন আরও অবনতির দিকে দ্রুত ধাবিত হবে। অতএব এখনই এই বৈষম্য দূর করে একটি বৈষম্যহীন বাস্তবমুখি সার্বজনীন শিক্ষা সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

গত জুলাই মাসে দেশ যখন ছাত্র জনতার আন্দোলন সংগ্রামে দিশেহারা, তখন আমরা সোনামুখ পরিবার থেকে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার ৬৪ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘুরে ঘুরে প্রতিভাবান শিক্ষার্থী খোঁজ করছিলাম। দেশ বিদেশে অবস্থানরত বিশিষ্ট শিক্ষক ও শিক্ষানুরাগী মানুষের পরামর্শ নিয়ে শুরু হলো প্রকৃত প্রতিভা অন্বেষণ। ১৪ টি ইউনিয়ন জুড়ে বিশাল ডুমুরিয়া থানার প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কয়েকটি মাদ্রাসায় গিয়ে প্রতিটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনা করে তাঁদের কাছে ১২ টি করে ফরম দেওয়া হয়। এই ফরম ছিল অনেক তথ্য সমৃদ্ধ। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান তাঁদের পছন্দমতো ১২ জন শিক্ষার্থী বাছাই করে ফরম পূরণপূর্বক আমাদের কাছে জমা দেন। আমরা সেই ফরম থেকে সকল শিক্ষার্থী একটি ডাটাবেজ তৈরি করি।

ডুমুরিয়া একটি বিশাল এলাকা হওয়ায় আমরা শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে সমগ্র ডুমুরিয়াকে দুইভাগে ভাগ করে, প্রথমে উত্তর ডুমুরিয়ার চারটি কেন্দ্রে ২১টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের লিখিত পরীক্ষার আয়োজন করি। একটি ব্যতিক্রমী পদ্ধতি অবলম্বন করে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এই পরীক্ষায় ২১ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ২১১ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। পরীক্ষার পর কয়েকজন বিশেষজ্ঞ শিক্ষক উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন। এই উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রথমেই আমরা মারাত্মক হোঁচট খাই। কারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিভায় আমরা ভীষণ মুগ্ধ হয়ে পড়ি এবং বাধ্য হয়ে অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থীকে যোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা চরমভাবে অবনতি হওয়ায় সরকার দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করায় দক্ষিণ ডুমুরিয়ার নির্ধারিত পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়।

৫ আগষ্ট দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আমরা পরিস্থিতি বুঝে গত ৮ ও ৯ নভেম্বর পূর্বের নির্বাচিত উত্তর ডুমুরিয়ার ২১১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করি। এই প্রশিক্ষণের বিষয় ছিল প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা ও প্রতিটি অক্ষরের সঠিক উচ্চারণ, নিয়মানুবর্তিতা, নিজেকে উপস্থাপন, শুদ্ধভাবে বক্তব্য উপস্থাপন, মানসিক দৃঢ়তা সৃষ্টি, সংকীর্ণতা পরিহার, স্মার্টনেস ও অভিভাবক সমাবেশ। এসব প্রশিক্ষণের প্রাণপুরুষ ছিলেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রশিক্ষক নূরুজ্জামান ফিরোজ। দুইদিন সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত শিক্ষার্থীর গভীর মনোযোগ সহকারে এই দীর্ঘ প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার পর তাদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেখা গেল- প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীর আমূল-পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমিসহ উপস্থিত সকল জ্ঞানীগুণীজন রীতিমতো বিস্মিত হয়ে পড়ি। মাত্র দুই দিনে এইসব শিক্ষার্থীদের পরিবর্তন ও ধারণ ক্ষমতা দেখে প্রশিক্ষক মহোদয় নিজেও হতবাক হয়ে পড়েন। তিনি বলেন- আমি বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলায় হাজার হাজার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দীর্ঘকাল যাবত প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছি। কিন্তু সোনামুখ পরিবারের ছেলেমেয়েদের মতো এতো ট্যালেন্ট ছেলেমেয়ে কোথাও পাইনি। সারা জীবন  যা শিখাতে আমার মাসের পর মাস সময় লাগে, এরা তা মাত্র দুই দিনে রপ্ত করেছে।

সোনামুখ প্রতিভা অন্বেষণ করতে গিয়ে এবং তাদের ইংরেজিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে আমাদের ইংরেজি প্রশিক্ষক সৌমেন মন্ডল স্যার ৪০০ পৃষ্ঠার একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম SPEAK ENGLISH WITH SONAMUKH. ইতিমধ্যে এই বইটি অনেক পাঠকের দৃষ্টি কেড়েছে। সোনামুখ প্রতিভা অন্বেষণের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বই পৌঁছে গেছে এবং ইংরেজি শিখতে আগ্রহী ছোট বড় দেশি বিদেশি পাঠকগণ বইটি সংগ্রহ করতে শুরু করেছেন। সকল বয়সী ইংরেজি পিপাসু শিক্ষার্থীদের জন্য বইটি অত্যন্ত উপযোগী।

সোনামুখ পরিবার এই ছেলেমেয়েদের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে নিতে সংকল্পবদ্ধ। তাদের স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হওয়ায় পরীক্ষা শেষে  ১০ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এইসব ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে ইংরেজিতে কথোপকথন ও মানবিক শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। দেশের অন্যতম স্বনামধন্য ইংরেজি প্রশিক্ষক বাবু সৌমেন মন্ডল ও প্রসেনজিৎ সরকার শিখিযেছেন ইংরেজি কথোপকথন ও বিশিষ্ট মানবিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. শাহ আলম এবং বিশিষ্ট সমাজকর্মী তাসলিমা খানম শিখিয়েছেন মানবিক মূল্যবোধ। আমরা এই সেশনের নামকরণ করেছিলাম- প্রকৃতির সাথে, ইংরেজিতে মেতে, থাকি একসাথে।

এরপর গত ২০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় প্রমিত বাংলা প্রশিক্ষণ। অধ্যাপক ড. সন্দীপক মল্লিক বাংলা সম্পর্কে মৌলিক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে রীতিমতো বাংলাবিদ করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। এরপর হবে গণিত অলিম্পিয়াড, কম্পিউটার অলিম্পিয়াড ইত্যাদি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রতিমাসের শেষ শুক্র ও শনিবার সৌমেন মন্ডল স্যার ইংরেজি প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখবেন। আমাদের সকল সেশনের মধ্যে কয়েকজন গোপন অবজারভার থাকেন। তাঁরা শিক্ষার্থীদের সকল কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে থাকেন এবং তাদের দেওয়া পূর্বের তথ্য ইতোমধ্যেই যাচাই বাছাই শুরু করেছেন। তারা সকল তথ্য যাচাই বাছাই করে সকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে কার কী প্রতিভা আছে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করবেন এবং যে শিক্ষার্থী যে বিষয়ে পারদর্শী তাকে সেই বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সার্বিক সহায়তা দেওয়া হবে। যে সকল শিক্ষার্থী আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল বলে বিবেচিত হবে, সোনামুখ পরিবারের পক্ষ থেকে তাদেরকে সাধ্যমতো মাসিক বৃত্তি প্রদান করা হবে। প্রতি বছর কিছু কিছু শিক্ষার্থী এই কার্যক্রম থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বেরিয়ে যাবে, আবার পূর্বের পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী বাছাই করে নেওয়া হবে। এভাবে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম চলতে থাকবে ইনশাআল্লাহ।

২৫ ডিসেম্বর সোনামুখ পরিবারের ৩২ তম জন্মদিন। কাকতালীয়ভাবে একই দিনে আমার একমাত্র মেয়ে ঈশারা বিনতে ইসলামেরও জন্মদিন। তাই একই সাথে এই দিনটি পালন করা হয়। ঐদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত চলে আনন্দ উৎসব। সোনামুখ প্রতিভা অন্বেষণের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দেশের বরেণ্য মানুষের আগমনে অনুষ্ঠানটি উপভোগ্য করে তোলা হয়।

সোনামুখ প্রতিভা অন্বেষণে অংশগ্রহণকারীদের সকল কার্যক্রম সার্বিক মূল্যায়ন করে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত দশ জনের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। এই দশজনকে অতিথিবৃন্দের হাত দিয়ে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়।

২৫ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইয়াহ্ইয়া আখতার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান, অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, খুলনা সরকারি সুন্দরবন কলেজের অধ্যক্ষ এটিএম আনিসুর রহমান, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, জার্মান প্রবাসী বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার ড. বিভূতি রায়, ঢাকা মণিপুর স্কুল ও কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ আব্দুল আহাদ, এডভোকেট আব্দুস সাত্তার, সোনামুখ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আলহাজ্ব শেখ আব্দুল জলীল, অধ্যাপক হাফিজুর রহমান, বিশিষ্ট শিক্ষা সেবক জনাব মাসুদ মাহমুদ, খুলনা আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠাতা বাবু বিধান চন্দ্র, ইঞ্জিনিয়ার ড. আবদুল গনি মোল্লা, ইঞ্জিনিয়ার সুকুমার বৈরাগী নিউটন, অধ্যাপক আমান উল্লাহ, নূরুল ইসলাম, সোনামুখ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা এ এম হারুনার রশিদ, অধ্যাপক ড. সন্দীপক মল্লিক, অধ্যক্ষ আবদুল মতলেব সরদার, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সাংবাদিক আব্দুল কাদের খান, ব্রাক ব্যাংকের ম্যানেজার জনাব ওয়াশিকুর রহমান, সোনামুখ প্রতিভা অন্বেষণে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের অভিভাবকবৃন্দ, সোনামুখের শিক্ষার্থীবৃন্দ, অধ্যাপক আঃ কাইয়ুম জমাদ্দার, মোঃ শাহজাহান জমাদ্দার, সোনামুখ প্রতিভার মূল কারিগর বিশিষ্ট প্রশিক্ষক নূরুজ্জামান ফিরোজ, ইংরেজির কারিগর বাবু সৌমেন মন্ডল, প্রসেনজিৎ সরকার ও আরও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।

অনুষ্ঠানটি অনলাইনে আমেরিকা থেকে উদ্বোধন করেন আমার মেয়ে ঈশারা বিনতে ইসলাম।

সোনামুখ পরিবার প্রতিষ্ঠার ৩২ বছর পূর্তিতে ৩২ পাউন্ড ওজনের জন্মদিনের কেক কেটে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। মাঝে চা, নাস্তা, কফিসহ দুপুরে ঐতিহ্যের নিদর্শন কলার পাতায় মেজবান খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল।

সোনামুখ পরিবারের এই ৩২ বছরের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে আমার কিছু অভিজ্ঞতা এখন তুলে ধরতে চাই।

# আমাদের দেশে বিভিন্নমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে মারাত্মক বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। কিছু কিছু অস্বচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষার্থী শহরকেন্দ্রিক ইংরেজি মাধ্যম বা ক্যাডেটে পড়ার সুবাদে বিশেষ মর্যাদার মানুষ হচ্ছে এবং সময় সুযোগমতো বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু এই সংখ্যা অতি নগন্য। এরা অধিকাংশই শহরের ছেলেমেয়ে। কিছু কিছু গ্রামের অস্বচ্ছল পরিবারের মেধাবী ছেলেমেয়েরাও এই সুযোগ নিচ্ছে। কিন্তু গ্রামের কিছু কিছু  অসাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা অর্থ ও সুযোগের অভাবে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে। আমরা এইসব সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের দক্ষতা কাজে লাগাতে চেষ্টা করছি।

# এই কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, শহরের তুলনায় প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা জন্মগতভাবে বেশি। কিন্তু তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সীমিত।

# আমরা আরও লক্ষ্য করেছি, গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুণী শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষক দায়সারাভাবে শ্রেণি কার্যক্রমে অবদান রাখেন। কিন্তু তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইন্ধনে পরিচালিত কোচিং বাণিজ্যে সর্বোচ্চ মনোনিবেশ করে আর্থিক লাভবান হওয়ায় ব্যস্ত থাকেন।

শুধু কোচিং বাণিজ্যে ব্যস্ত থেকেই ক্ষান্ত হন না, বরং আমরা সোনামুখ পরিবার থেকে প্রতিভা অন্বেষণে গিয়ে তাদের অসহযোগিতা ও বিরূপ সমালোচনার শিকার হই। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষক হিসেবে যোগ্য নয়। আর যারা যোগ্য তারা নিজের কোচিং বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত অথবা অযোগ্য শিক্ষক ও রাজনৈতিক ম্যানেজিং কমিটির লোক দ্বারা কোণঠাসা অবস্থায় কোনমতে মানসম্মান নিয়ে মাথা নিচু করে চলেন। অর্থাৎ যোগ্য শিক্ষকবৃন্দ নানাভাবে লাঞ্ছিত ও অবহেলিত বা শিক্ষার্থী বান্ধব নয়।

এই টানাপোড়েনের মধ্যে আর্থিক অস্বচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীরা অকালে ঝরে পড়ছে।

# আমাদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে আর একটি আশাব্যাঞ্জক অথচ ভয়াবহ চিত্র। মেধাবীদের তালিকায় মেয়েদের অবস্থান প্রায় ৮০ শতাংশ। ছেলেরা সেখানে অনেক পিছিয়ে আছে। আমাদের প্রশিক্ষণ ক্লাসেও মেয়েদের রেসপন্স বেশি। ছেলেরা চুপচাপ বসে থাকে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মেয়েরা এগিয়ে। ছেলেরা শুধু শ্রোতা। সৃজনশীলতার দিকে মেয়েদের অবদান বেশি। এমনকি খেলাধুলা এবং দুষ্টুমির সময়ও ছেলেরা পিছিয়ে পড়ে। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে অদূর ভবিষ্যতে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য ভাল ছেলে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। ছেলেরা লজ্জাবতি লতা হয়ে পড়ছে, যা হওয়ার কথা ছিল মেয়েদের।

# বাঙালির মজ্জাগত স্বভাব হলো পরশ্রীকাতরতা। আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সেই স্বভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তারা একে অপরের ভুল ত্রুটি ধরতে চায়, কিন্তু একে অপরকে উৎসাহ দিতে চায় না। আমরা সেরা দশজনকে পুরস্কার দিতে গিয়ে এটা গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি।

আমাদের ‘সোনামুখ প্রতিভা অন্বেষণ’ ফেসবুক পেজের পোস্ট ও মন্তব্য পর্যালোচনা করতে গিয়ে আমার চোখে ধরা পড়েছে যে, তাদের মধ্যে অনেক প্রতিভা আছে, কিন্তু তারা একে অপরের ভাল পোস্টে তেমন প্রশংসা করে না। বরং নেগেটিভ দৃষ্টিতে দেখে এবং সবাই নিজ নিজ পোস্ট দেখেই তৃপ্ত থাকে।

# আমাদের এলাকায় হিন্দু অভিভাবকবৃন্দ অনেক বেশী শিক্ষা সচেতন। আমরা দেখেছি, দূর দূরান্ত থেকে হিন্দু মা-বাবা তাদের সন্তানদের সাথে নিয়ে আমাদের প্রশিক্ষণে এসে সার্বক্ষণিক বসে থেকেছেন, তাদের সন্তানের ভালমন্দ ও সমস্যার কথা আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। কিন্তু মুসলমান অভিভাবকদের মধ্যে এই প্রবণতা নেই বললেই চলে। বরং কিছু কিছু মুসলমান শিক্ষার্থীর মেধা উপলব্ধি করে তাদের অভিভাবকদের সাথে সরাসরি ও মোবাইলে যোগাযোগ করে উপযুক্ত সাড়া না পেয়ে আমরা মর্মাহত হয়েছি।

# দেশের মানুষের মধ্যে ফ্রী পাওয়ার প্রবণতা অত্যন্ত বেশী।  তাই শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এই প্রবণতা গড়ে উঠেছে। তারা অধিকাংশই আমাদের আর্থিক সহায়তা পেতে বেশী আগ্রহী। আর্থিক সহায়তা পেতে অস্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের সাথে স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের মনোভাব লক্ষণীয়।

আমরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ডাটাবেইজ সংরক্ষণ করেছি। যার যা প্রয়োজন তাকে সেই সহায়তা দিয়ে মেধা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।

# এলাকার মানুষ আমাদের কর্মকাণ্ড কিভাবে নিচ্ছেন তা আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি। কিছু মানুষের নেগেটিভ চিন্তা আমাদের কিছুটা কষ্ট দিলেও আমরা তা আমলে নিচ্ছি না। আমাদের কাজ আমরা করে যাবো ইনশাআল্লাহ। যারা আমাদের এই কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত আছেন, তারা সকলেই এ ব্যাপারে বদ্ধপরিকর।

# এলাকার সাংবাদিক ভাইয়েরা আমাদের এই কর্মকাণ্ড কিভাবে নিচ্ছেন তা আমরা বুঝার চেষ্টা না করলেও তাদের প্রচার প্রচারণার আগ্রহ কম বলে মনে হয়েছে। জাতিগতভাবে আমরা নেগেটিভ মানসিকতার জাতি। তাই পজিটিভ সংবাদ আমাদের সাংবাদিক ভাইদের তেমন চোখে পড়ে না বলে মনে হয়েছে। তোষামোদ করে যদি কেউ ভাল কাজের তথ্য সাংবাদিক ভাইদের দেয় তাহলে মন চাইলে প্রচার করে। কিন্তু কোন নেগেটিভ খবরের গন্ধ পেলে নিজের গরজে, নিজের খরচে প্রচারের জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। অবশ্য এটা আমাদের জাতীয় চরিত্র। একটি জাতির পিছিয়ে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন তা আমাদের সবার মধ্যে আছে।

এতোসব নেগেটিভ চিন্তার দেশে জন্ম নিয়ে, দূষিত বাতাসে বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের মাঝে আলো ছড়াতে চেষ্টা করে যাবে সোনামুখ পরিবার। আল্লাহর অশেষ রহমতে ৩২ বছর ধরে কিছু কিছু মহান মানুষের সহায়তায় আমরা আমাদের আদর্শ ধরে রাখার চেষ্টা করে চলেছি। আল্লাহ চাইলে সকল অপরাজনীতির উর্ধ্বে থেকে জাতিধর্ম নির্বিশেষে আগামীতে সকল ভাল কাজের সাথে থাকবো ইনশাআল্লাহ।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!