বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে করা মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশকেই ভেঙে নিজেদের জন্য সমুদ্রপথ তৈরি করার হুমকি দিলেন ত্রিপুরার নেতা তিপ্রা মথা দলের প্রধান প্রদ্যোত মানিক্য।
এছাড়া আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা ড. ইউনূসের মন্তব্যকে আপত্তিকর বলে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে কংগ্রেস নেতা পবন খেরা একে উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য বিপজ্জনক বলে মন্তব্য করেছেন।
ড. ইউনূসের মন্তব্য
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, চীনে চার দিনের সফরের সময় ড. ইউনূস বলেছেন, ‘ভারতের সাতটি রাজ্য, যা পূর্ব ভারত ও সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত, সেগুলো একেবারে ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ডলকড)। তাদের সমুদ্রে যাওয়ার কোনো পথ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের অভিভাবক। এটি এক বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করে, যা চীনের অর্থনীতির সম্প্রসারণের সুযোগ এনে দিতে পারে।’
ড. ইউনূসের এই মন্তব্যের ফলে ভারতের রাজনৈতিক মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে এমন সময়ে, যখন শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতে চাইছে।
আসামের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের এই মন্তব্য খুবই আপত্তিকর এবং নিন্দনীয়। এটি ভারতের কৌশলগত ‘চিকেনস নেক’ করিডোরের দুর্বলতা নিয়ে প্রচলিত বর্ণনাকে পুনরায় উসকে দিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের মধ্যে এমন কিছু শক্তিও অতীতে এই সংকীর্ণ ভূখণ্ডকে বিচ্ছিন্ন করার পরামর্শ দিয়েছে, যা উত্তর-পূর্বকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। তাই আমাদের অবশ্যই আরও শক্তিশালী রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে ‘চিকেনস নেক’ করিডোরকে বাইপাস করার মতো নতুন রুট তৈরি করতে হবে।’
ত্রিপুরার প্রতিক্রিয়া
এদিকে ত্রিপুরার তিপ্রা মথা দলের প্রধান প্রদ্যোত মানিক্য বলেন, ‘ভারতকে এখনই সমুদ্রপথে নিজস্ব সংযোগ তৈরি করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ-নির্ভরতা কমানো যায়। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। এখন এই অস্থায়ী সরকার সমুদ্রের অভিভাবক হওয়ার দাবি করছে, যা হাস্যকর।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি আমরা নতুন অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশকেই ভেঙে সমুদ্রপথ নিশ্চিত করাই ভালো। চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত বহু ত্রিপুরি, গারো, খাসিয়া ও চাকমা জনগোষ্ঠী নিজেদের ঐতিহ্যবাহী ভূমিতে অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে বসবাস করছে। তাদের অধিকার ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় এই সুযোগ ব্যবহার করা উচিত।’
কংগ্রেস নেতা পবন খেরার সতর্কবার্তা
কংগ্রেস নেতা পবন খেরা বলেন, ‘বাংলাদেশ চীনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে একটি অবরোধ তৈরি করতে চাইছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি এতটাই দুর্বল যে, যার জন্মের জন্য আমরা অবদান রেখেছিলাম, সেই দেশই এখন আমাদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে।’
বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া
ভারতের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সঞ্জীব সান্যাল বলেন, ‘ড. ইউনূসের বক্তব্য খুবই কৌতূহলজনক। চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে, কিন্তু তিনি ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর ভূমিবেষ্টিত অবস্থান নিয়ে কেন কথা বলছেন?’
বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ড. ইউনূসের মন্তব্যকে ‘অত্যন্ত হতাশাজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ‘উত্তর-পূর্ব ভারতের সমুদ্রপথ ব্যবহার নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি রয়েছে। ইউনূসের মন্তব্য এই ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে।’
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন টানাপোড়েন
সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নানা কারণে টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কে অবনতি দেখা দিয়েছে।
এদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে ড. ইউনূসকে একটি বার্তা পাঠিয়ে দুই দেশের অংশীদারিত্ব জোরদারের প্রতিশ্রুতি দেন। তবে ড. ইউনূসের এই মন্তব্য সেই কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে বলেই মনে করছেন ভারত সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র: এনডিটিভি
খুলনা গেজেট/এএজে