বৃহত্তর খুলনা জেলার সাতক্ষীরার দরগাহপুর শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় দিক দিয়ে একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। ষোড়শ শতকের দিকে মোগলদের শাসনামলে এই গ্রামের গোড়া পত্তন হয়। বিখ্যাত ধর্মীয় সাধক যিনি বাগদাদ থেকে এসেছিলেন বলে বাগদাদী নামে পরিচিত।
বিশ্ব বিখ্যাত আলেম, ভারতের বিধান সভার সদস্য, বোখারী শরীফের বাংলা অনুবাদকারী ও সুবক্তা মরহুম মাওলানা শেখ বজলুল রহমান দরগাহপুরী, কারী ও সমাজসেবক মরহুম মাহমুদ আলী, বিখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মরহুম আবদুল ওহাব সিদ্দিকী যেমন এই গ্রামে জন্মগ্রহণ করে এলাকাকে ধন্য করেছেন, তেমনি এই এলাকায় জন্ম নিয়েছেন সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ডাক্তার, সাংবাদিক, অধ্যাপক, আলেম, হাফেজ, বিচারক ও ব্যবসায়ী।
দরগাহপুরের একজন কৃতি সন্তান মরহুম ডাক্তার শেখ রেজাউল হোসেন। যিনি অত্র এলাকাসহ খুলনায় সত্তুর ও আশির দশকে রাজা ডাক্তার নামে পরিচিত ছিলেন। রাজার মতই ছিল তার চলাফেরা। সদা হাস্যময়ী এই মানুষটি দরগাহপুর গ্রাম তথা অত্র এলাকার প্রথম এমবিবিএস ডিগ্রিধারী। রাড়ুলীর বিখ্যাত পিসি রায় বিদ্যালয় হতে এসএসসি, খুলনা সরকারি বিএল কলেজ হতে এইচএসসি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস পাস করেন। কিছু দিন পর তিনি সাবেক পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ইপিসিএস পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। তিনি খুলনার খালিশপুর লাল হাসপাতাল ও খুলনা সদর হাসপাতালে সুনামের সাথে চাকরি করেছেন। আশির দশকে তিনি কয়েকবছর নাইজেরিয়ায় চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তীতে দেশে ফিরে তিনি খুলনা শেরে বাংলা রোডে একটি বাড়ি কেনেন এবং তার অদম্য ইচ্ছে জনসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। এই সময় তিনি তার ব্যক্তিগত চেম্বারে গরীব ও অসহায় রোগীদের নিকট হতে ফি নিতেন না। এমনকি ঔষধ এবং টাকা দিয়ে সহযোগিতাও করতেন।
একদিনের ঘটনা এখনো আমার মনে রয়েছে। আমার এক বন্ধু তার আব্বাকে নিয়ে ডাক্তার রেজাউল হোসেনের কাছে গেছেন চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করার জন্য। তিনি সময় নিয়ে রোগী দেখতেন। তাকে দেখে যখন বিদায় দিচ্ছেন। তখন আমার বন্ধুটি তার ফি দিতে গেলে ফি না নিয়ে বললেন কয়রা পাইকগাছা ও আশাশুনি এলাকার মানুষের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করলে আমার এলাকার মানুষের জন্য কি দায়িত্ব পালন করলাম? যদিও তখন কয়রা পাইকগাছার মধ্যে ছিল।
মুরব্বিদের কাছে জেনেছি, যখন দরগাহপুর যেতেন সকাল থেকে রাত অবধি রোগী দেখতেন। কার বাড়ির কি অবস্থা খবর নিতেন। অসহায়দের মুক্ত হস্তে দান করতেন। এই মহত মানুষটি আজকের আমাদের এলাকার চিকিৎসা সেবার পথপ্রদর্শক।
তিনি যে সময়ে চলে গেলেন (১৯৮৮) না ফেরার দেশে সেটা কেউ কল্পনা করতে পারেনি। তবে সব কিছু মহান আল্লাহর ইচ্ছে।
ডাক্তার রেজাউল হোসেনের পিতা আলহাজ্ব শেখ আবদুল নুর। ডাক্তার রেজাউল হোসেনের সহধর্মিণী চেমন আরা বেগম রুবি। দুই ছেলে ও চার মেয়ের জনক তিনি। ছেলে ও মেয়ে এবং জামাইরা উচ্চ শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে তৌহিদ মনোয়ার হোসেন, ছোট ছেলে শহিদ মিনহাজ হোসেন প্রথমে বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপটেন পরে কাতার এয়ার লাইন্সে এবং সর্বশেষ ইউএস বাংলার ক্যাপটেন হিসেবে কর্মরত। বড় মেয়ে মেহেরা আফসানা সরকারি আযম খান কমার্স কলেজ হতে ডিগ্রি লাভ করেন। ২য় মেয়ে রেহেনা আফসানা সরকারি বিএল কলেজ হতে অনার্স সহ এমএ, ৩য় বনানী আফসানা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্থাপত্যে ডিগ্রি অর্জন করেন এবং কানাডায় কর্মরত এবং ছোট মেয়ে লাবনী আফসানা এমবিবিএস করে অস্ট্রেলিয়ায় চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত।
লেখক : ইউএনবির খুলনা প্রতিনিধি ও যুগ্ম সম্পাদক, খুলনা গেজেট।