দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অপার সম্ভাবনাময় স্থলবন্দর হচ্ছে ভোমরা। পূর্ণাঙ্গ বন্দর হওয়া সত্ত্বেও অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা ও সবধরণের পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুযোগ না থাকায় ভোমরা স্থলবন্দর ব্যবহারে ক্রমশঃ আগ্রহ হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে সাতক্ষীরার ভোমরা শুল্ক স্টেশনটি তার কাঙ্খিত রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ব্যবসায়িদের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই বন্দরটি হয়ে উঠতে পারে দেশের সবচেয়ে বেশী রাজস্ব আয়ের বন্দর।
বন্দর সূত্র জানায়, দেশ স্বাধীনের পর থেকে ভোমরা ইমিগ্রেশন চেকপোষ্ট দিয়ে শুধুমাত্র দু’দেশের পাসপোর্ট যাত্রীরা আসা যাওয়া করতে পারতেন। আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ স ম আলাউদ্দিনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৯৬ সালে ভোমরা বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার ১৭ বছর পর ২০১৫ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ভোমরা বন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর হিসেবে ঘোষণা দেন। এরপর দুইটি ওয়্যারহাউজ, ওয়েব এক্সেল, ওয়াচ টাওয়ার ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণসহ নানা অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু ভোমরা শুল্ক স্টেশনটির কার্যক্রম এখনো পরিচালিত হচ্ছে কয়েকটি জরাজীর্ণ ভবনে। ফলে নানামুখি সমস্যার সম্মুখিন হতে হয় রাজস্ব কর্মকর্তাদের।
তবে, পূর্ণাঙ্গ বন্দর ঘোষণার এতদিন অতিবাহিত হলেও পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অপার সম্ভাবনাময় ভোমরা স্থল বন্দরটি দিয়ে শুধুমাত্র অল্প সংখ্যাক পণ্য আমদানী রপ্তানী হয়। অপর দিকে দেশের অন্যান্য বন্দর দিয়ে সকল পণ্য আমদানী রপ্তানী হয়। ফলে নানাবিধ সমস্যা আর বৈষম্যের কারণে অনেক ব্যবসায়ী এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য বন্দরে চলে যাচ্ছেন। সকল প্রকার পণ্য আমদানী রপ্তানীর সুযোগ না থাকায় সাতক্ষীরার ভোমরা শুল্ক স্টেশনটি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সম্ভাবনাময় এ স্থলবন্দরটি দিয়ে সকল প্রকার পণ্যের আমদানি রফতানির সুযোগের পাশাপাশি ব্যবসায়িদের সবধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই বন্দর হতে বছরে লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ টাকার রাজস্ব আয় করা সম্ভব।
ভোমরা বন্দরের ব্যবসায়ি আবদুল গফুর সরদার জানান, এই বন্দর ব্যবহারে আমাদের পরিবহন খরচ খুবই কম হয়। কিন্তু ব্যবসায়িদের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা এখানে নেই। বেনাপোল বন্দরে আমদানি পণ্য ঢোকার পর ডিউটি দিয়ে তা ছাড় করাতে হয়। আর এখানে আগে ডিউটি পরিশোধ করে তারপর বন্দরে পণ্য ঢোকাতে হয়। এছাড়া ভোমরা বন্দরে ওয়ারহাউজ থাকলেও ব্যবসায়িদের তা ব্যবহার করতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে অনেক সময় পণ্যবাহী ট্রাক সড়কের উপর দাড় করিয়ে আনলোড করতে হয়। এছাড়া ভোমরা বন্দরে মালামাল লোড আনলোডে দ্বিগুণ লেবার খরচ দিতে হয়, যা অন্য কোন বন্দরে নেই। ফলে ভোমরা বন্দরে এধরনের অব্যবস্থাপনার করণে ব্যবসয়িদের নানাবিধ সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়।
ভোমরা স্থল বন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম বলেন, ভোমরা বন্দর দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বন্দর। অথচ সবধরনের পণ্য আমদানির সুযোগ না থাকায় এ বন্দর ব্যবহারে ব্যবসায়ীরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ভোমরা বন্দর দিয়ে ৭৭টি পণ্য আমদানির অনুমোদন থাকলেও এনবিআর স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কিপিং লাইসেন্স একটি স্ট্যাডিং অর্ডারের মাধ্যমে আটকে রেখেছে। তাই মাত্র ২০/২৫টি পণ্য আমদানি করা যায়। অথচ এই বন্দর থেকেই সরকারের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আয় হওয়ার কথা।
তিনি আরো বলেন, কলকাতা থেকে ভোমরা বন্দরের দূরত্ব সবচেয়ে কম। মাত্র ৭৫ কিলোমিটার। অথচ দেশের প্রধান স্থল বন্দর বেনাপোলের দূরত্ব ১১৮ কিলোমিটার, সোনামসজিদ বন্দরের দূরত্ব ৩২২ কিলোমিটার ও হিলি বন্দরের দূরত্ব ৩১৮ কিলোমিটার। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে লাভের জন্য। তাই ভোমরা বন্দরের দূরত্ব কম হওয়ায় পরিবহন খরচও কম হয়। কিন্তু সব পণ্য আমদানি করা যায় না বলে ব্যবসায়ীরা অন্য বন্দরে যেতে বাধ্য হয়। আর পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে ভোমরা বন্দরের সম্ভাবনা আরো বেড়ে যাবে। তাই ভোমরা বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা রয়েছে সেগুলো নিরসন করা গেলে সরকারের রাজস্ব আয়ের দিক থেকে এই বন্দর হবে দেশের সেরা বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ভোমরা স্থল বন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আরাফাত হোসেন বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে আমরা নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছি। আগে এই বন্দর দিয়ে ফল আমদানি হতো। হয়রানির শিকার হয়ে ব্যবসায়িরা হিলিসহ অন্য বন্দর দিয়ে ফল আমদানি করছেন। হিলি বন্দর দিয়ে ফল এনে আমাদের সাতক্ষীরার মানুষের খেতে হচ্ছে। পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় ফলও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে আমাদের। ভোমরা দিয়ে এখন শুধু পাথর বেশি আমদানি করা হচ্ছে। সাথে অল্প কিছু পেঁয়াজ ও শুকরা মরিচসহ অন্যান্য কয়েকটি পণ্য রয়েছে। ফলে ব্যবসায়িরা সবধরনের পণ্য আমদানির সুযোগ না পেয়ে চলে যাচ্ছে অন্য বন্দরে। যার প্রভাব পড়ছে বন্দরের রাজস্ব আয়ের উপর। তিনি অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটিয়ে এই বন্দর দিয়ে সবধরনের পণ্য আমদানির সুযোগ সৃষ্টির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
ভোমরা স্থল বন্দরের উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম জানান, ভোমরা বন্দর রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সম্ভাবনাময়ী। কিন্তু এই বন্দর দিয়ে অল্প সংখ্যাক পণ্য আমদানী রপ্তানী হয়ে থাকে। এখানে বিভিন্ন বিধি নিষেধ আছে এবং আবকাঠামোগত অসুবিধা আছে। এ সব সমস্যা দুর হলে এই শুল্ক স্টেশনটি হয়ে উঠতে পারে দেশের সবচেয়ে বেশী রাজস্ব আয়ের বন্দর।
ভোমরা কাস্টমসের সহকারি কমিশনার আমির মামুন জানান, এই বন্দরে বিভিন্ন ধরনের ৭৭টি আইটেমের পণ্য আমদানির অনুমোদন আছে। কিন্তু ব্যবসায়িরা ২০ থেকে ৩০ ধরনের পণ্য আমদানি করে থাকেন। এখানে অবৈধ সুযোগ সুবিধার কোন বিধান নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যবসায়িরা যেখানে সুযোগ বেশি পায় সেখানেই যায়। সুযোগ না পেয়ে ব্যবসায়িরা অন্য বন্দর দিয়ে ফল আমদানি করছে। তবে আমাদের এখানে রাজস্ব আদায় ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনাকালিনও এই বন্দরে ৫৭৯.২৮ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়। যেখানে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ৬১.৫৫ কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থ বছরে ভোমরা বন্দরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৪০.৮৩ কোটি টাকা। অর্থ-বছর শেষ হতে এখনো বেশ কিছু দিন বাকী। আশা করছি এবার উদ্বৃত্তের পরিমাণ আরো বাড়বে। তিনি বলেন, আমাদের কাস্টমসের ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। খুব শিগগিরই কাজ শেষ হবে।
খুলনা গেজেট/এনএম