খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৬শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  চার দিনের সফরে চীনের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস
  জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা
  গৌরবময় স্বাধীনতা দিবস আজ

সুপেয় পানি সংগ্রহে উপকূলের নারীদের এখনও হাঁটতে হয় দীর্ঘ পথ

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

গ্রীষ্মের শুরুতেই বৃষ্টিহীনতার কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আস্তে আস্তে নেমে যাওয়ায় পানি কম উঠে জেলার উপকূলীয় এলাকার বেশির ভাগ অগভীর ও গভীর নলকূপে। একই সাথে প্রাকৃতিক পানির আধার গুলোর অধিকাংশ শুকিয়ে যাওয়ায় খাবার পানির সংকট দেখা দেয়। ফলে সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগরে সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য এখনও নারীদের হাঁটতে হয় দীর্ঘ পথ।

শ্যামনগরের ভেটখালী গ্রামের রাণী গাইন বলেন, সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য বাড়ি থেকে লম্বা পথ হেঁটে এসে তাদের পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

হাটছোলা গ্রামের গৃহবধু অর্পণা রানী, কুলসুম বেগম বলেন, সকালে সকল কাজ শেষ করে বিকালে সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য ফ্রি করে রাখতে হয়। এরপর পানি সংগ্রহের জন্য পিএসএফে (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) এসে আবার লম্বা লাইন সেখানেও সময় লাগে।

পানখালী আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দা মনজিলা বেগম, আসমা বেগম বলেন সরকারিভাবে তৈরি আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাস করি। এখানে সুপেয় পানির সমস্যা রয়েছে।

এমন ভাবে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে শ্যামনগর উপজেলার বারোটি ইউনিয়নের কমবেশি গ্রামগুলোতে। এক কলসি পানি সংগ্রহের জন্য নারীদের পরিবারের অন্যান্য কাজ সমাপ্ত করে অথবা প্রয়োজনের সময় পানি সংগ্রহের জন্য লম্বা পথ হাঁটতে হয়। উপজেলার অনেক স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল পরিবারেও সুপেয় পানি ক্রয় করে খেতে হয়।

উপজেলা সদরের বাসিন্দা গৃহিনী শর্মিষ্ঠা রানী বলেন, বছরের বারো মাস সুপেয় পানি ও রান্নার পানি ক্রয় করে খেতে হয়।

মুন্সিগঞ্জ জেলেখালী গ্রামের বাসিন্দা রনজন পরামান্য, ধানখালী গ্রামের বাসিন্দা খোকন বৈদ্য, আটুলিয়ার বাসিন্দা বিশাখা রানী বলেন, সুপেয় পানির সংকট শুষ্ক মৌসুমে প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে পানির ড্রাম ক্রয় করে নিতে হয়।

তারা বলেন, এক ড্রাম পানির মূল্য ৩০ থেকে ৪০ টাকা। ড্রামে পানি থাকে ৩০ থেকে ৪০ লিটার বা তারও বেশি।

উপকূলের অসংখ্য মানুষ সুপেয় পানির জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। কোন পরিবার পিএসএফ থেকে, কোন পরিবার আরও প্লান্ট থেকে, আবার কোন পরিবার বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করছেন নিজস্ব রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্লান্ট থেকে। যারা এসকল উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করতে পারছেন না তাদের কম লবণযুক্ত পানি বা মানসম্মত না এমন পিএসএফ থেকে সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার বাসিন্দা নজরুল গাজী, রমজাননগরের বাসিন্দা ফজলু বলেন শ্যামনগর উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় আইলায় সমগ্র এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণে সুপেয় পানির উৎস অনেকাংশে নষ্ট হয়। এছাড়া উপজেলায় লবণ পানির চিংড়ি চাষ হওয়ায় লবণাক্ততার প্রকোপও বেশি। উপজেলায় শুষ্ক মৌসুমে শুধু খাওয়ার পানির নয়, ব্যবহারের পানিরও সংকট পড়ে যায়। বিভিন্ন ইউনিয়নে শুধু পানি আর পানি থাকলেও সেটি লবণ পানি, ব্যবহারযোগ্য পানি নয়। এই লবণ পানির চিংড়ি ঘেরের কারণে পার্শ্ববতী মিষ্টি পানির পুকুর বা জলাশয়ের পানি লবণাক্ত হচ্ছে। এর ফলে সে পানিও পানযোগ্য বা ব্যবহারযোগ্য থাকছে না।

এছাড়া গ্রীষ্মের শুরুতেই বৃষ্টিহীনতার কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আস্তে আস্তে নেমে যাওয়ায় পানি কম উঠে উপকূলীয় এলাকার বেশিরভাগ অভীর ও গভীর নলকূপে। কাজেই সুপেয় পানির সংকট নিরসনে শেষ ভরসা পুকুরের পানি। সেটিও লবণ পানির প্র্রভাব থাকার ফলে অনেক পরিবারের সদস্যদের চর্মরোগ, আমাশয়, ডায়রিয়া লক্ষ্য করা যায় যা উপকূলের অনেকেই জানান।

শ্যামনগর উপজেলার নারী সংগঠন নকশীকাঁথার পরিচালক চন্দ্রিকা ব্যানার্জী বলেন, তিনি নিজেও সুপেয় পানি ক্রয় করে থাকেন। গরমের সময়ে গোসলের পানিও ক্রয় করতে হয় বলে জানান। উপজেলার অনেক এলাকায় নারীরা কোলের শিশু নিয়েও পানি সংগ্রহ করেন পিএসএফ থেকে।

বেসরকারী সংগঠন লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল বলেন, তার সংগঠন থেকে পানি সংকট সমাধানে উপকারভোগিদের এটিএম কার্ড করে দেওয়া হয়েছে যার মাধ্যমে এক কলসি করে পানি সংগ্রহ করতে পারবেন। প্রত্যহ তাদের ভ্রাম্যমাণ পানি বিতরণের ট্যাংক গাড়ি থেকে। কিন্ত এটি হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি গ্রামে প্রতিদিন যাতায়াত করে পানি সরবরাহ করা হয়।

শ্যামনগর উপজেলা কৃষি অফিসার নাজমুল হুদা বলেন, উপজেলায় লবণ পানির প্রভাবে কৃষিতে প্রভাব পড়ছে। লবণ পানির প্রভাব যেখানে কমছে সেখানে দিনে দিনে আমন ও বোরো চাষের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুকনা মৌসুমে খালগুলিতে মিষ্টি পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে কৃষি ফসল তরমুজ, মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়স, ডাল, সরিষা বা অন্যান্য ফসলের চাষ বৃদ্ধি পেত।

শ্যামনগর উপকূলের শ্যামনগরে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম প্লান্ট বা পানির ট্যাংক বিতরণ করা হচ্ছে সরকারিভাবে। কিন্ত ৩৫০০ লিটারের পানির ট্যাংকের পানি ৫/৬ সদস্যের পরিবারে সারা বছর চলে না। পন্ড স্যান্ড ফিল্টার বা পুকুর ফিল্টার মূলত পুকুরের পানির উপর নির্ভরশীল। শুকনা মৌসুমে অনেক পুকুরে পানি না থাকার জন্য পিএসএফ অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ থাকে।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, শ্যামনগরে চার লাখের বেশি মানুষের বসবাস। এখানে সুপেয় পানির সংকট সমাধানে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বারোটি ইউপিতে সরকারিভাবে স্থাপনকৃত পিএসফ সংখ্যা ২৫০টির বেশি, বেসরকারীভাবে ৫০০টির বেশি। গভীর নলকূপ সরকারিভাবে স্থাপনকৃত ৪৫০০টি ও বেসরকারীভাবে ২০০০টি। অগভীর নলকূপ ৫০টির উপরে। রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং প্লান্ট পরিবার পিছু সরকারিভাবে ৫০০০টির উপরে এবং বেসরকারীভাবে ২৫০০টি। কমিউনিটি নলকুপ সরকারিভাবে স্থাপন ২০টি ও বেসরকারীভাবে ২৫টি। রিভার্স অসমোসিস প্লান্ট সরকারিভাবে ৫টি ও বেসরকারীভাবে ১০০টির উপরে।

শ্যামনগর উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বেসরকারীভাবে স্থাপনকৃত রিভার্স অসমোসিস প্লান্টগুলো মনিটরিং করা প্রয়োজন। এ প্লান্টে ব্যবহৃত কার্বন ফিল্টার ৬ মাস পর পর পরিবর্তন করা প্রয়োজন, আর মেমব্রেনগুলি ২বছর পর পরিবর্তন করা দরকার। বেসরকারীভাবে নির্মিত প্লান্ট গুলি নিয়ম মেনে চলে কিনা তা সঠিক তিনি জানেন না বলে জানান।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!