খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

সুন্দরবনে একদিন

গৌরাঙ্গ নন্দী

হাত বিশেক প্রস্থের একটি জলপথ। এক সময়ের প্রমত্তা ভোলা, যামরে গিয়ে নাম হয়ে ছেমরা-ভোলা। সেই মরা-ভোলার বুকের মাটি কেটে আবারও নদীর চেহারা দেওয়ার চেষ্টা। নদী-ত হয়নি, হয়েছে খাল।

সেই খালেই ভেসে চলেছে আমাদের বহনকারী ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি। দক্ষিণ পাশে বাদাবন। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট।সুন্দরবন। উত্তর পাশে বসতি। ইঞ্জিনের ক্রমাগত ভটভট শব্দ চলেছে। আরও আছে অল্প-বিস্তর কালো ধোঁয়া। আচ্ছা, শব্দে কী বন্যপ্রাণ বিরক্ত হয় না! বিরক্ত হলেও সে তো প্রতিবাদ করতে পারে না, তাই অত্যাচারও চলে সমান তালে।শুধু কী শব্দের যন্ত্রণা! আরও কত যন্ত্রণা সইতে হয় যে, মহাপ্রাণ সুন্দরবনকে!

ইঞ্জিনের শব্দ থেমে যায়। নৌকা ভেড়ে তীরে। কেউ একজন চেঁচিয়ে বলেন, কিছু ধরে থাকবেন, ধাক্কা লাগবে, দাঁড়িয়ে থাকারা পড়ে যেতে পারেন। নৌকাটি তীরের মাটিতে ধাক্কা খেল।

নিউটনের গতি সূত্রের তৃতীয় ধারাটি মেনে নৌকা যাত্রীদের অনেকেই বিপরীত দিকে হেলে পড়লেন। পড়ি কী মরি অবস্থা! কেউ কেউ চিৎকার করে উঠলেন! কে যেন আরও চিৎকার করে ধমক দিয়ে উঠলেন, এক দমক থানা।আমরা বনে এসেছি। এটি লোকালয় নয়। চিৎকার, চেঁচামেচি করে বন্যপ্রাণকে বিরক্ত করা যাবে না। ধীরে ধীরে নামুন।আস্তে আস্তে মাটিতে পা দিন। লাফ দেবেন না। লাফ দিলে নৌকা সরে যাবে, আর আপনি পড়ে যাবেন।

একে একে সবাই নদী-তীরের উঁচু রাস্তার উপর দাঁড়ালো। প্রকৃতপক্ষে সেটি রাস্তা নয়। ভোলা নদীর বুক থেকে কাটা মাটি নদী-তীরে জমা করা হয়েছে। এতে নদীর তীর বরাবরউঁচু রাস্তা হয়ে গিয়েছে। সেই রাস্তা থেকে অন্তত: হাত তিনেক নীচে বন-ভূমি। ছোট-বড় অসংখ্য গাছ। দু’পাশের গাছগুলো ধনুকের মতো বেঁকে কাছাকাছি এসেছে। ভূমিতে পায়ে চলা পথ।পরিস্কার। বনের গভীরে চলে গিয়েছে। বুঝাই যায়, অনেক দিন ধরে চলাচলে পথটি বেশ স্বচ্ছ। চারিদিকে বলা গাছের সারি। দূরে হেঁতাল গাছও চোখে পড়ে। একী! সুন্দরবনে রেইনট্রি বা চম্বল গাছ। এ গাছ তো ম্যানগ্রোভ বৈশিষ্ট্যের নয়।ওই যে কাঁঠাল গাছ, আম গাছও আছে। এগুলো-ত সমতল ভূমির গাছ! একজন বন-কর্মী ব্যাখ্যা দিলেন, বেশ কয়েক বছর আগে সুন্দরবনে একটি প্রকল্পের আওতায় এই গাছগুলো লাগানো হয়েছে, গাছগুলো এখন বড় হয়েছে। বাদাবনের সেই রাস্তায় আমরা প্রবেশ করি। ছায়াঘেরা বনভূমি। নোনাজলের ভূমি। এখানকার গাছ গুলো সমতল ভূমির চেয়ে আলাদা।সমতলে যেসব গাছ-পালা জন্মে, সাধারণভাবে সেগুলো এখানে জন্মানোর কথা নয়। এখানকার গাছগুলো ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। সাধারণভাবে মরুভূমির গাছগুলোর যেমন বৈশিষ্ট্য, তেমনি। মরুভুমির গাছগুলো পানি কম পায়, তাই নিজেকে টিকিয়ে রাখতে এর কান্ড অধিক পরিমাণে তরল ধরে রাখে, পাতা গুলো ছোট হয়। ম্যানগ্রোভেরও তাই।উদ্ভিদরাজি নোনাজলের ভূমিতে জন্মালেও সে নোনাজল গ্রহণ করতে পারে না, তাই সে পানি ধরে রাখে। গেওয়া, কাঁকড়া, সুন্দরী গাছগুলোর কান্ড কাটলে তাই এক ধরনের তরল নির্গত হতে দেখা যায়; যা আঁঠালো, ঘন এবং অনেকক্ষেত্রেই দুধের মত সাদা। আর গাছগুলোর পাতা ছোট। পাতা বড় মানে বেশী পরিমাণে অক্সিজেন ত্যাগ করার প্রয়োজন হয়।নিজ শরীরে সে কার্বন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস ধরে রাখে। পাতায় মোমের প্রলেপ দেওয়ার মত আস্তরণ থাকে।
বলাগাছ, কাণ্ড বেশী মোটা নয়, লতানো গাছের মত। হেঁতাল গাছের প্রায় সর্বাঙ্গে কাঁটা। পাতা কম।তাহলে এরা কীভাবে শ্বসন প্রক্রিয়া টিকিয়ে রাখে।এই কারণে মাটি ফুঁড়ে এদের শিকড় উপরে ওঠে। বলে শুলো। গাছের আকৃতি-প্রকৃতি বিবেচনায় শুলো উঁচু, বড়ও মোটা হয়। তবে অগ্রভাগ সুঁচালো, কাণ্ডটি বেজায় শক্ত।যে কারণে সুন্দরবনে হেঁটে চলা বেশ শক্ত। এ কারণে হাঁটার সময় বিশেষ ধরনের কেডস বা প্লাস্টিক জাতীয় জুতো পরলে সুবিধা হয়।আমাদের দলে আনোয়ার ভাইয়ের সেই রকম জুতা ছিল। অন্যদের স্বাভাবিক জুতা-সেন্ডেল। কিছু দূর যেতে না যেতেই আমরা শুলোর মুখোমুখি হলাম। বেমানান জুতো-সেন্ডেলের বিড়ম্বনা তখন সকলেই অনুভব করতে শুরু করেছি।পায়ে চলা পথটি পানিতে পূর্ণও কর্দমাক্ত । ক’দিন আগের প্রবল বৃষ্টিতে বন-ভূমি ভেজা এবং পথের এই দশা। পানি, কাদা এড়াতে পথ ছেড়ে বনের মধ্যে দিয়ে চলার চেষ্টা করি। শুলোর দাপটে পা ফেলা দায়! হেতাল কাঁটার খোঁচা। আর মশার আক্রমণ।বনে ঢোকার আগে বন কর্মকর্তা সতর্ক করেছিলেন, আমরা যে অঞ্চলটিতে যাচ্ছি, সেখানে মশা খুব।তাই শুনে আমাদের দলনেতা জ্যোতির্ময় দা’ মশা প্রতিরোধক শরীরে মাখতে বলেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল, তিনিই সকল সঙ্গীদের দিকে তা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।আমিও হাতে, গলায় মেখেছিলাম। কিন্তু বাঁ হাতের কব্জিতে জ্বালা অনুভব করতে শুরু করি।তাকিয়ে দেখি একটি মশা সেখানে বসে আরামে রক্ত শুষে চলেছে। আর এক হাতের আঘাতে সেটাকে মেরে ফেলি; পরক্ষণেই দেখি, জায়গাটি ফুলে উঠেছে, আর চুলকাচ্ছে।

একী! আগাতেই পারছি না। শুলোর আঘাতে বনের মধ্যে দিয়ে চলা দু:সাধ্য। আবারও জল-কাদাময় হাঁটা পথে নামি।পায়ে জুতোসহ-ই এগুতে থাকি। পাজল-কাদায় ডুবে যায়। আবার তুলি। বনকর্মকর্তাটি বারে বারে সতর্ক করেছিলেন, কোন অবস্থায়ই খালি পায়ে হাঁটবেন না, তাহলে পা কেটে যেতে পারে, ক্ষত তৈরি হতে পারে। কারণ, মাটিতে কী আছে, তা আমরা জানি না, শামুক বা সাপ থাকতে পারে, আর কাটা গাছের গোড়ার অংশও থাকতে পারে।এগুনো কষ্টসাধ্য হওয়ায় সঙ্গী বন কর্মকর্তার নির্দেশে একজন বনরক্ষী হাত তিনেক লম্বা ডাল কেটে আমাদের ধরিয়ে দিলেন।ডান হাতে সেই লাঠিতে ভর করে এগুনো বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের হওয়ায় মনে মনে, উচ্চ-স্বরে একাধিকবার তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম।
লাঠিতে ভর দিয়ে জল-কাদার পথ মাড়িয়ে এগুচ্ছি। পায়ে যেন কী জড়িয়ে গেল। আঁতকে উঠি। সাপ না-কি! আসার আগেই বনঅফিসে একটি অজগর সাপ ছেড়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা দেখেছি।ওই অজগর সাপটিকে ভোলা নদীরও পাশের গ্রাম থেকে সকাল বেলায় বন-রক্ষীরা উদ্ধার করেছিল।আজকাল প্রায়ই অজগর নদী পেরিয়ে লোকালয়ে যায় খাবারের খোঁজে। এই অজগরটিও একটি ছোট ছাগল মুখে পোরার চেষ্টা করছিল।গৃহকর্তা দেখে ফেলায় হৈ চৈ করে লোক জড়ো করেন। অজগরটি ভয়ে গুটিয়ে যায়। খবর পেয়ে বনরক্ষীরা ছুটে এসে অজগরটি ধরে ফেলে।তেরো ফুট লম্বা অজগরটি বস্তায় পুরে রাখা হয়েছিল। আমরা বন দেখতে গিয়েছি, আমাদের সামনেই বন-রক্ষীরা সেই অজগরটিকে বনে অবমুক্ত করলেন।

বনের সীমান্তে ভোলা নদীর পশ্চিমপাড়ে বনের টহল ফাঁড়ি অফিস। এই অফিসের পিছনেই বাঘের আনাগোনা।বনকর্মীরা দেখেছেন। আমাদের সে কথাও জানানো হ’ল। আমাদের দলের একাধিক সদস্যের মুখ ভয়ে পাংশুটে হয়ে যায়। বনে ঢোকার সময় বনরক্ষীরা থাক বেকী-না, তাঁদের হাতে অস্ত্র থাকবে কী-না, এ নিয়ে জোর আলোচনা হ’ল।অবশেষে সামনে পিছে দু’জন করে চারজন রাইফেলধারী রক্ষী নিয়ে আমাদের সাত সদস্যের দলটি বনে প্রবেশ করে। বনের সেই জল-কাদা পথেই কী সাপ পা পেঁচিয়ে ধরলো! ধীরে ধীরে পা উঠিয়ে দেখা গেলো, না, গাছের লতানো কাণ্ডে পা জড়িয়েছে।
এভাবেই ঘন্টাখানেক ধরে এগুনো। এরই মাঝে আমাদের অন্যতম সঙ্গী শুভঙ্কর দা’ পড়ে গিয়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছেন।তিনি আর পা ফেলতে পারছেন না। তাকে বনরক্ষীরা সহায়তা করে নৌকার কাছে নিয়ে বসিয়েছেন। আমরা এগুতে থাকি। চোখে পড়ে বেশ বড় বড় গর্ত। পানি ধরে রাখার জন্য এগুলো কয়েকদিন আগে খোঁড়া হয়েছে।
সুন্দরবনের পূবের এই এলাকাটি অন্যান্য এলাকার চেয়ে উঁচু এবং শুষ্ক। এখানকার ভোলা ও খড়মানদী দুটোই শুকিয়ে গিয়েছে। ভোলা নদীটি কেটে আবারও খালের ন্যায় চেহারা দেওয়া হয়েছে।

এলাকাটি শুকনো হওয়ায় বনের পাতা ঝরে স্তুপ হয়, সেই পাতায় আগুন লাগে, ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকদিন আগে, ৪মে ২০২৪ এ এই অঞ্চলে আগুন লাগে। আগুন নেভাতে পানি ধরে রাখতে তাই জায়গায় জায়গায় গর্ত করা হয়েছে। জানা গেল, এখন প্রায় প্রতি বছর আগুন লাগে। ১৯৭০ সালের দিকে প্রথমে না-কি আগুন লেগে ছিল। ১৯৭০ থেকে ২০২৪, এই ৫৪ বছরে ৪০ বার আগুন লেগেছে। বন অফিসের কাছে সংরক্ষিত তথ্য মতে, ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সালের হিসেবে দেখা যায়, ২৫ বার আগুন লেগেছে।

আরও বেশ খানিকটা এগিয়ে আমাদের চোখ ছানাবড়া! এ-কী! গাছের কাণ্ডগুলো পোড়া, কালো। পাতা নেই।বিস্তৃত এলাকা জুড়ে কালো কাণ্ডের ছড়াছড়ি। ৪মে ২০২৪ এর আগুনে এখানকার সাত একরেরও বেশী এলাকা পুড়ে গেছে।কীভাবে আগুন লেগেছে, তা জানা যায়নি। আগের আগুন লাগারও কারণ জানা যায়নি। এখানেই, এই অঞ্চলটাতেই আগুন লাগে। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে প্রায় প্রতি বছরই আগুন লাগছে।

এবারে আগুন লাগার সময় চল্লিশ ডিগ্রী বা তার আশেপাশে তাপমাত্রা চলছিল বেশ কয়েকদিন ধরে। এটি জলা ভূমির বন। এই বনে ঘর্ষণের ফলে আগুন লাগার কথা নয়। তাহলে কী কেউ আগুন লাগিয়ে দিল। বলা হয়, আগুন কেউ লাগিয়েই দেয়। তা না হলে বারেবারে কেন আগুন লাগবে! আমাদের দলের সঙ্গী অপরাজিতা সেখানেই বন-কর্তার সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করে। আগুন লাগা সম্পর্কে তার ধারণা কী বুঝার চেষ্টা করে।সাক্ষাৎকারটি ভিডিও করায় তিনি বেশ বিচলিত হন। বোধ করি, উপরের কর্তার সাথে ফোনে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি কথা বলেন।

ওই পোড়া জায়গাটির বেশ খানিকটা এলাকা, বড়জোর এক একরের মত জায়গা ঘুরে-ফিরে আবারও সেই পথে আমরা মরা ভোলা নদীর পাড়ে আসি। ফেরার পথে পা পিছলে শুলোর সারির উপর পড়ে যেতে যেতে কীভাবে নিজে টাল সামলেছি, ভাবলেই অবাক হতে হয়। পড়ে যাওয়ারই কথা ছিল, কিন্তু রক্ষা পেয়েছি।হোঁচট খেয়ে অপরাজিতার ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের নখ উল্টে গেছে। সবমিলিয়ে বনে চারঘন্টার এই যাত্রায় আমরা ছয় হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও (বাংলাদেশ অংশে) বেশী এলাকার সুন্দরবনের এক প্রান্তের মাত্র কিলোমিটার দুই ভিতরে গিয়েছি।পোড়া জায়গাটির বড় জোর একর খানেক জায়গা দেখেছি, তাতেই আমরা গলদ ঘর্ম, ক্লান্ত, শ্রান্ত। নিম্ন-গাঙ্গেয় অববাহিকার সমুদ্র কুলে জোয়ারে আসা পলি থিতু হয়ে জমা ভূমিতে তিন শতাধিক উদ্ভিদ, ছয় শতাধিক প্রাণী, পাঁচ শতাধিক নদ-নদী-খাল-নালা নিয়ে মহাপ্রাণ সুন্দরবনের অবস্থান। ঝড়-ঝঞ্জা-জলোচ্ছ্বাস হতে জনপদকে রক্ষা করে চলেছে এ বন। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে রক্ষাকারী সুন্দরবন বেঁচে থাকুক।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!