সব মৃত্যু মানুষকে কাঁদায়। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু মানুষকে কিছু সময়ের জন্য হলেও কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে তোলে। যে মৃত্যু পুষিয়ে নেয়ার জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়। আজ সকালে এমন একটি সংবাদে আমি কিছু সময়ের জন্য খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।
যখন সকালে জানলাম খুলনা সিটি কর্পোরেশনের প্রথম প্রশাসক ও খুলনা পৌরসভার শেষ চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম রোববার ভোরে ইন্তেকাল করেছেন, তখন আমি খেই হারিয়ে ফেলি।
তিনি শুধু একজন ব্যক্তি সিরাজুল ইসলাম নয়, তিনি একটি প্রতিষ্ঠানও। তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী এবং ধর্মীয় চেতনা সম্পন্ন মানুষ। বয়সের তারতম্য থাকলেও আমি তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছি। আমি তাঁকে দেখেছি একজন মানুষ সম্পদশালী ও উচ্চবিত্ত হওয়ার পরও কত নিরহংকারী ও অমায়িক হতে পারে।
তাঁকে দেখেছি প্রশাসকের পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর পিকচার প্যালেস মোড়ে অবস্থিত হোটেল গোল্ডেন কিং থেকে পায়ে হেটে জোহর, আছর, মাগরিবের নামাজ পড়তে ধর্মসভা মসজিদে যেতেন। একা একা হেটে যেতেন বলে একদিন বলেছিলাম, চাচা এই বয়সে একা না যেয়ে কাউকে সঙ্গে নেওয়া উচিত। চাচা বলেছিলেন, আমার কোন শত্রু নেই। আল্লাহ ভরসা। আল্লাহ উপর ছিল যার অগাধ আস্থা ও ভরসা।
সিরাজুল ইসলাম চাচা যখন খুলনা পৌরসভার শেষ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, তখন কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্তমান মেয়র আলহাজ্ব তালুকদার আবদুল খালেক, মরহুম শেখ আবুল কাশেম, মরহুম শেখ আবুল হোসেন, কাজী আমিনুল হক, মনু কমিশনার, মরহুম শেখ দবির উদদীন, মরহুম কাজী সেকেন্দার আলী ডালিমসহ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি।
আমি অনেকের কাছ থেকে জেনেছি, তিনি কি সুন্দরভাবে এই কমিশনারদেরকে ম্যানেজ করতেন। তার মধ্যে কোন লোভ লালসা ছিল না। তিনি ছিলেন দুর্নীতিমুক্ত একজন মানুষ।
তিনি সাধারণত পায়জামা ও পাঞ্জাবী পরতে পছন্দ করতেন। কিন্তু ১৯৮৪ সালে যেদিন শহীদ হাদিস পার্কে সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ খুলনা পৌরসভাকে সিটি কর্পোরেশন ঘোষণা করেন সেদিন তিনি কোট প্যান্ট ও টাই পরিধান করে ওই অনুষ্ঠানে সভাপতির আসন গ্রহণ করেন।
আজকের বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠনে তাঁর অবদান অতুলনীয়। ব্যক্তিজীবনে মুসলিম লীগের অনুসারী ছিলেন তিনি। মরহুম খান এ সবুর তাঁকে খুব ভালবাসতেন।
ন্যাপের মরহুম ফেরদৌস ভাই, মুসলিম লীগের মরহুম শেখ মোহাম্মদ আলী, ডুমুরিয়ার হামিদ আলী গোলদার, আবদুল জলিল, খুলনার আর এক কৃতি সন্তান আবু মিয়া, ব্যারিস্টার আহাদ আলী ছিল তার সমসাময়িক ও বন্ধু।
তিনি খুলনা ইসলামিয়া কলেজসহ বহু স্কুল ও মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসায় অকাতরে দান করতেন এবং বহু ছাত্র ছাত্রীকে উচ্চ শিক্ষার জন্য আর্থিক সহায়তা করতেন।
সিমেট্রি রোডে মিলে বসে তাঁর সাথে অনেক গল্প করতাম। আশা ছিল তাঁর মায়ের নামে খুলনায় একটা মেডিকেল কলেজ করা।
তাঁর দুই সন্তান ও চার মেয়ে। তারা সকলেই প্রতিষ্ঠিত। দুই সন্তান ব্যবসায়ী। যদিও বড় সন্তান শিপার কিছুদিন অধ্যাপনা পেশায় জড়িত ছিলেন।
জামাইদের মধ্যে একজন ছিলেন অতিরিক্ত সচিব (অব) আর দু’জন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। অন্যজন হোটেল পার্ক ও সুন্দরবন হোটেলের মালিকদের একজন। ভাই এ কে এম আবদুল রউফ বাংলাদেশ সংবিধানের লিপিকার।
সিরাজুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৩ সালে ৬ জুলাই নুরনগরের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে। তার ইন্তেকালের মধ্যে দিয়ে খুলনার স্থানীয় মানুষের একটা অধ্যয় শেষ হয়ে গেলো। আল্লাহ তুমি সিরাজুল ইসলাম চাচাকে জান্নাতের মেহমান করে নিও।
লেখক : খুলনা প্রতিনিধি, ইউএনবি ও যুগ্ম সম্পাদক, খুলনা গেজেট।
খুলনা গেজেট/এনএম