দল পরিচালনা নিয়ে অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিক মনজুরুল আহসান খান।
দলের সাবেক এই সভাপতি সর্বশেষ সিপিবির উপদেষ্টা পদে ছিলেন। এর আগে শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে গত ফেব্রুয়ারিতে তাকে চিরতরে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা পদ এবং ছয় মাসের জন্য দলের সদস্য পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
সেই শাস্তির পাঁচ মাসের মাথায় রোববার সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মনজুরুল আহসান খান সিপিবি থেকে তার পদত্যাগ করার ঘোষণা দিলেন।
তিনি অভিযোগ করেছেন, “পার্টি পরিচালনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি অগ্রাহ্য করে গায়ের জোরে, আধিপত্যবাদী কায়দা চলছে।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘‘আপনারা আগেই এটা জেনেছেন যে, গত ২৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কমিটি সভায় মনজু ভাই (মনজুরুল আহসান খান) পার্টির শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে আমরা কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা পদ থেকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতি দিয়েছিল এবং পার্টির সদস্য পদ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেছি। তখন কেন্দ্রীয় কমিটির ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল এই সময়কালে উনি যদি আরও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন তাহলে তার সদস্যপদ বাতিল করা হবে।
“এই ধারাবাহিকতায় আমাদের পার্টির ১২ ও ১৩ তারিখে কেন্দ্রীয় কমিটির সভা ছিল, সেই সভায় উনার সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে। অর্থাৎ উনি আর আমাদের পার্টির সদস্য না।”
মনজুরুল আহসান খান সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) থেকে পদত্যাগ করেছি। গত ৩ জুলাই আমার পদত্যাগপত্রটি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রেরণ করি এবং তারা সে পত্র গ্রহণ করে।”
পাকিস্তান আমলে ৬০ এর দশকে বাম রাজনীতিতে যুক্ত হন মনজুরুল আহসান খান। ১৯৯৯ সালে তিনি সিপিবির সভাপতি নির্বাচিত হন। দায়িত্ব পালন করেন টানা ১৩ বছর। ২০১২ সালে সভাপতি পদে পরিবর্তন এনে তাকে দলের উপদেষ্টা করা হয়।
বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে নিজের পদত্যাগপত্রটিও সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়েছেন মনজুরুল আহসান খান। সেখানে সিপিবির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের উদ্দেশে তিনি লিখেছেন, “আমি দীর্ঘদিন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং জীবিত কমরেডদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আছি। আমার বিরুদ্ধে সাতবার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ বার অভিযোগ পাওয়ার পর আমি সে সম্পর্কে তদন্ত করতে বলেছিলাম। আপনারা তদন্ত না করেই চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
“সাম্প্রতিককালে লুটপাটতন্ত্র, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ‘বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প’ গড়ার জন্য কংগ্রেসে গৃহীত সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্যুত হয়ে বিশ্বাসঘাতকতামূলকভাবে সুবিধাবাদী-সংস্কারবাদী লাইন অনুসরণ করে চলেছেন। পার্টি পরিচালনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি অগ্রাহ্য করে গায়ের জোরে, আধিপত্যবাদী কায়দায় ও হুকুমদারির রেজিমেন্টেশনের পদ্ধতিতে পার্টি চালাচ্ছেন। এমতাবস্থায় আমি পার্টি থেকে পদত্যাগ করছি।”
পদত্যাগপত্রে সিপিবির সাবেক সভাপতি বলেন, “পার্টির সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে যে বিপুল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি এবং তার সঙ্গে সঙ্গে মার্কসবাদী দর্শনের যে মর্মবাদ আত্মস্থ করেছি; তা আমার জীবন-পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পার্টির অন্যান্য কমরেড যারা এখনো বিপ্লবী আদর্শের প্রতি অবিচল, তারা পার্টিকে সঠিক পথে নিয়ে আসবে এবং বিশ্বাসঘাতকদের পার্টি থেকে চিরতরে বহিষ্কার করবে।”
মনজরুল আহসান খানের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমার যা কিছু বলার তা পদত্যাগপত্রে বিস্তারিতভাবে বলেছি। নতুন করে কিছু বলার নেই।”
যা ঘটেছিল
গত ফেব্রুয়ারিতে দলের সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছিলেন মনজুরুল আহসানের খানেরে তাদের দলের মধ্যে নানান সময় নানান অভিযোগ ছিল।
“সবশেষ গত ১৭ তারিখে তিনি একটি পত্রিকায় যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাতে দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও কেন্দ্র সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছেন, সেটা গঠনতন্ত্র বিরোধী ছিল বলে নেতৃবৃন্দ মনে করেছেন। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
প্রিন্স বলেন, সেই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বক্তব্যের বিষয়ে মনজুরুলকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছিল। তিনি যে জবাব দিয়েছেন, সেটি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে মনঃপূত হয়নি।
সে সময় মনজুরুল বলেন, “আমি একটি চিঠি পেয়েছি। এ বিষয়ে আমি এখন কোনো কথা বলতে চাই না।”
কী বলেছিলেন মনজুরুল?
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মনজুরুল আহসান সিপিবির বর্তমান নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য সম্মেলন করার কথা বলেন।
তিনি পত্রিকাটিকে বলেন, “বর্তমান সিপিবির নেতৃত্বে রয়েছে একটা সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। এরা অতীতেও কোনো আন্দোলন করেনি, বর্তমানেও করে না, এমনকি আমরা শ্রমিকদের নিয়ে যে সংগ্রাম পরিষদ করেছি, তাদের আন্দোলনেরও বিরোধিতা করে।”
তার বিরুদ্ধে সিপিবির অতীতের ব্যবস্থা নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে দলের সাবেক সভাপতি বলেন, “আমাকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। পাঁচ দফা অভিযোগ তুলে আমাকে শোকজ করেছে। যদিও শোকজ তিন মাস ধরে করেছে, কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পায়নি, কেননা পার্টির অধিকাংশ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এটার বিরোধিতা করবে।
“আমাকে মোট পাঁচবার পার্টি থেকে সাসপেন্ড করেছে। এখন আরেকবার করতে চাচ্ছে কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। আমরা সম্মেলন করে বর্তমান নেতৃত্বকে সরিয়ে দেব।”
খুলনা গেজেট/এনএম