বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিষেধাজ্ঞায় এবং সিন্ডিকেট সভার অধিকাংশ সদস্যের বিরোধিতার কারণে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) বিধিবহির্ভূতভাবে কিছু কর্মকর্তাদের ৪র্থ গ্রেডে পদোন্নতির সুপারিশ ভেস্তে গিয়েছে।
শনিবার (০১ জুন) সিন্ডিকেটের ১০৩তম সভায় বাছাই বোর্ডের সুপারিশসমূহ অনুমোদনের জন্য আলোচ্যসূচিতে দেওয়া হলেও উপস্থিত সদস্যবৃন্দ সেটিতে অনুমোদন দেননি। সভায় উপস্থিত একাধিক সদস্য এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে হাজারো সমালোচনার মধ্যেই নীতিমালা লঙ্ঘন করে কর্মকর্তাদের ৪র্থ গ্রেডে পদোন্নতি দিতে বাছাই বোর্ড সম্পন্ন করেছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হাসিবুর রশীদ। কিন্তু বাছাই বোর্ডের ওই সুপারিশে অনুমোদন দেয়নি সিন্ডিকেট।
এর আগে নজিরবিহীন গোপনীয়তায় কিছু কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (৪র্থ গ্রেড) ও সমপর্যায়ের পদে পদোন্নতি দিতে শুক্রবার (৩১ মে) বাছাই বোর্ডের আয়োজন করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হাসিবুর রশীদ। বিষয়টি জানতে পেরে আগের দিন বৃহষ্পতিবার (৩০ মে) বোর্ড বন্ধ করে এ বিষয়ে লিখিতভাবে জানাতে বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দিয়েছিল ইউজিসি। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও শুক্রবার বেলা ৩টায় উক্ত বাছাই বোর্ড অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে উত্তরবঙ্গের সংবাদসহ অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমগুলোতে সংবাদ প্রকাশিত হলে নানা মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পাশাপাশি, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল ইউজিসি কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, এর আগেও বেশ কয়েক বার বাছাই বোর্ডের আয়োজন করলেও ইউজিসির নিষেধাজ্ঞায় সফল হননি উপাচার্য। কিন্তু এবার অনিয়ম করে এই পদোন্নতি দিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এমনকি কৌশল অবলম্বন হিসেবে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে প্রার্থীদের শুধু মোবাইলে কল করে বোর্ডে উপস্থিত হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। পাঠানো হয়নি কোনোরূপ খুদে বার্তা, ই-মেইল। এমনকি কোনো কার্ড ইস্যু করা হয়নি প্রার্থীদের জন্য। কিন্তু বিষয়টি ইউজিসির নজরে এলে বৃহষ্পতিবার এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তারা।
নথিপত্র থেকে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার ও সমমর্যাদার চতুর্থ গ্রেড এর পদসমূহে কর্মকর্তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসির বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী উম্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। এ বিষয়ে ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি সাধারণ নির্দেশনা প্রদান করে ইউজিসি। যেখানে বলা হয়, প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, অর্থ ও হিসাব এবং লাইব্রেরি এই চার দপ্তরে ৪র্থ গ্রেডভুক্ত অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার বা সমমানের পদ থাকবে। এই পদসমূহে ইউজিসির অনুমোদন সাপেক্ষে উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সরাসরি নিয়োগ দিতে হবে। পদোন্নতি/আপগ্রেডেশন/পর্যায়োন্নয়ন দেওয়া যাবে না।
কিন্তু ইউজিসির এই নির্দেশনা অমান্য করে বেরোবির উপাচার্য অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার/সমমানের পদে পদোন্নতির জন্য গত ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে প্রথম বার কর্মকর্তাদের ৪র্থ গ্রেডে পদোন্নতি দেয়ার জন্য বাছাই বোর্ডের আয়োজন করেছিলেন। বিষয়টি ইউজিসির নজরে আসলে ১১ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে পদোন্নতি বা আপগ্রেডেশন কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ প্রদান করে এবং দুই কার্যদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা তলব করেছিল।
পরে ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তারিখে পুনরায় একই পদে আপগ্রেডেশনের জন্য বাছাই বোর্ডের সভা আহ্বান করা হলে কমিশন আবারো ১০ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে পুনরায় এ সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দুই কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনকে লিখিতভাবে জানাতে বলে। ফলে দ্বিতীয় দফায় বোর্ডের কার্যক্রম ভেস্তে যায়।
ইউজিসির নিষেধাজ্ঞার কারণে উপাচার্য অধ্যাপক হাসিবুর রশীদ বাছাই বোর্ডের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের আপগ্রেডেশন দিতে না পেরে সরকারি ‘‘চাকরি [স্ব-শাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ] (বেতন ভাতাদি) আদেশ ২০১৫ এর অনুচ্ছেদ ১২’’ এর ভুল ব্যাখাপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাগণকে ৪র্থ গ্রেড প্রদানের কার্যক্রম গ্রহণ করলে কমিশন দুই দফা চিঠি দিয়ে সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে এই প্রক্রিয়াটিও বাতিল হয়ে যায়।
ইউজিসির এত আপত্তির পরেও তাদের নির্দেশনা অমান্য করে নতুনভাবে নানা কৌশলে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে গত ৩১ মে ২০২৪ শুক্রবার বিকেল ৩টায় ৪র্থ গ্রেডে পদোন্নতি দেয়ার জন্য বাছাইবোর্ডের আয়োজন করা হয়েছিল। একই সাথে এই নিয়োগ দ্রুত অনুমোদনের আজ ১ জুন শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করা হয়েছিল। এর আগের উদ্যোগগুলো ভেস্তে যাওয়ায় এবার যাতে নিয়োগ কার্যক্রমের খবর ইউজিসি জানতে না পারে সেজন্য নজিরবিহীন গোপনীয়তা রক্ষা করেছেন ভিসি। বাছাই বোর্ডের জন্য প্রার্থীদের কোনো কার্ড ইস্যু করা হয়নি, দেওয়া হয়নি এসএমএস। সংস্থাপন শাখার অফিসিয়াল মোবাইল নম্বর থেকে উপ-রেজিস্ট্রার শামীমা সুলতানা গত বুধবার বিকেল ৫টার পর থেকে ২৫ জন প্রাথর্ীকে মোবাইলে কল করে বোর্ডে উপস্থিত হতে বলেন। এরপরেও এটি ইউজিসির নজরে আসলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় তারা।
কিছু কর্মকর্তার দাবি, একজন শিক্ষক নেতার স্ত্রী এবং জনসংযোগ দপ্তরে কর্মরত এক কর্মকর্তাসহ উপাচার্যের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাকে ৪র্থ গ্রেডে প্রমোশন দিতেই মুলত মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন উপাচার্য। এভাবে আপগ্রেডেশন দেওয়া হলে অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বঞ্চিত হতেন এবং তারা হারাতেন চাকরির জ্যেষ্ঠতা।
প্রসঙ্গত, কর্মকর্তাদের ওই বাছাইবোর্ডে সভাপতিত্ব করেন উপাচার্য নিজেই। সদস্য হিসেবে উপস্তিত ছিলেন ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মো. মজিব উদ্দিন আহমেদ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার। কিন্তু সভার অন্য সদস্যদের বিরোধিতার কারণে আপগ্রেডেশনের অনুমোদন পেতে ব্যর্থ হন উপাচার্য।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আপগ্রেডেশন বন্ধ করতে ইতোমধ্যে বৃহস্পতিবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছিল। তবুও তারা আপগ্রেডেশনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সিন্ডিকেটে আপগ্রেডেশনের বিষয়টির অনুমোদন না হওয়ায় বিষয়টি তাদের নিজেদের জন্যই ভালো হয়েছে।
পরে বিধিবহির্ভূতভাবে আপগ্রেডেশনের বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদসহ সিন্ডিকেটের একাধিক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি।
খুলনা গেজেট/এনএম