সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর দেশে আর ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ক্রসফায়ারের ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফে তিনি অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত হন।
সবধরণের বিচারবহির্ভূত হত্যা মানবাধিকার লঙ্ঘন। এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবারই প্রশ্ন তুলেছে বা তুলছে। সাধারণ জনগণের মধ্যেও এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। কথিত ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা এনকাউন্টারের নামে সংঘঠিত হয় মানবাধিকার বিবর্জিত এ হত্যাকান্ড। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য মতে, এপর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত খুব একটা আলোর মুখ দেখেনি, হয়নি বিচারও। সর্বশেষ ৩১ জুলাই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। এরপর ফের দেশজুড়ে আলোচনায় আসে বিচারবহির্ভূত হত্যা। এক পর্যায়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- এটাই শেষ ঘটনা। মানবাধিকার কর্মীদের প্রশ্ন- তাহলে কি সত্যিই বন্ধ হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড?
আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ২৮ জুলাই পর্যন্ত দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১৯৬টি। ২০১৯ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ৩৮৮টি, ২০১৮ সালে ৪৬৬টি, ২০১৭ সালে ১৬২টি। পুলিশ কাস্টডিতে থাকা অবস্থায়ও অনেকের মৃত্যু হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা ২০১৬ সালে ছিল ১৯৫টি, ২০১৫ সালে ১৯২টি, ২০১৪ সালে ১৫৮টি এবং ২০১৩ সালে ২০৮টি। এসব হত্যাকান্ড নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। তারপরও এধরনের হত্যাকাণ্ড থামছেই না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহতরা সকলেই নিরাপরাধী, তা বলছে না মানবাধিক সংগঠনগুলো। তারা বলছে, আইনের আওতায় এতে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক; তবে কোনভাবেই বিচারের আগেই হত্যা নয়।
সর্বশেষ, ৩১ জুলাই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তার একদিন আগে, গত ৩০ জুলাই ভোরে র্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ খুলনার রূপসা উপজেলার নৈহাটি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ওরফে মিনা কামাল (৫৫) নিহত হন। মিনা কামালের বিরুদ্ধে হত্যাসহ কয়েকটি মামলা ও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এ দু’টি ঘটনার পর আর ‘বন্দুকযুদ্ধের’ খবর পাওয়া যায়নি। যদিও এর আগে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ খবর আসতো।
গত ৬ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘কক্সবাজারের টেকনাফে মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান পুলিশ সদস্যের গুলিতে মারা যান। অনাকাঙ্খিত এই ঘটনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ অত্যন্ত মর্মাহত। পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, এটাই শেষ ঘটনা। ভবিষ্যতে এই ধরনের কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।’ আইএসপিআর দেয়া ‘কক্সবাজারে সেনাবাহিনী প্রধান ও পুলিশ মহাপরিদর্শক কর্তৃক স্ব স্ব বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান’ শীর্ষক এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়।
জানা গেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা সব সময়ই এ বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। এ অবস্থায় ২০০৬ সালের আগস্টে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) হাইকোর্টে একটি রিট করে। এই রিটের প্রাথমিক শুনানি করে ওই বছরের ৬ আগস্ট হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে নিরাপত্তা হেফাজতে আটক ব্যক্তিদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ কেন দেয়া হবে না-এ মর্মে কারণ দর্শাতে বলা হয়। এই রিটের রুল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে এখনো।
এরপর ২০০৯ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও অবৈধ ঘোষণার নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এবং কর্মজীবী নারী জনস্বার্থে ২০০৯ সালের ২১ জুন হাইকোর্টে রিট করেন। রিটটির প্রাথমিক শুনানি গ্রহণের পর ২৯ জুন হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ রুল জারি করেন। ‘ক্রসফায়ারের’ নামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কেন অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে নাÑ এ মর্মে কারণ দর্শাতে বলা হয়। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), র্যাবের মহাপরিচালক ও স্বরাষ্ট্র সচিবকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। কিন্তু সেই রুলেরও জবাব দেয়া হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি।
এরপর ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর মাদারীপুরে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই ভাই-লুৎফর খালাসী (৪৫) ও খায়রুল খালাসী (৩০) নিহত হন। ‘সংবাদমাধ্যমে এ খবর জেনে’ বিচারপতি এএফএম আবদুর রহমান ও বিচারপতি ইমদাদুল হক আজাদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ পরদিন সুয়োমোটো রুল জারি করেন। আদালত রুল জারি করে আর যেন ক্রসফায়ার না ঘটে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের কাছ থেকে অঙ্গীকারও নিয়েছিলেন। এরপর সরকারপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সেই বছরের ১৪ ডিসেম্বর অবকাশ শেষে আদালত খোলার এক সপ্তাহ পর ওই রুলের শুনানির দিন ধার্য করা হয়। এরপর আর শুনানি হয়নি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, শুধু মেজর সিনহা নন, দেশের সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসতে হবে।
আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক জানান, যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার নির্ধারিত হবে জনদাবি আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে। রিট মামলা যেগুলো হয়েছে, সেগুলোয় ফল আসবে তখনই যখন এর পেছনে আইনি যুক্তি ছাড়াও জনদাবি এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হবে। আর এটা যত তাড়াতাড়ি হবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল।’
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনার সমন্বয়ক এ্যাড. মোমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা কথিত বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার নিয়ে বিগত দেড় দশক ধরে কথা বলছি। বন্ধের দাবি করছি। কিন্তু আমাদের দাবিতে কোনো সরকার কর্ণপাত করেনি। এখন মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে, হতেই হবে। আর এর মধ্য দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের দাবি বাস্তবায়িত হবে, আমরা এ প্রত্যাশা করতে চাই।
খুলনা গেজেট/এআইএন