আজ ২৫ মার্চ, বাঙালি জাতির ইতিহাসের ভয়াল কালরাত। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে ১৯৭১ সালের এই রাতেই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহ গণহত্যা হয়। সেদিন ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী। এক রাতেই বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে লাখো বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এই মর্মন্তুদ গণহত্যা আজও বিশ্বের মানুষের কাছে ঘৃণ্যতম ও তমসাচ্ছন্ন এক অধ্যায়।
দিনটি স্মরণে ২০১৭ সালে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণা করে সরকার। এ উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার দেশজুড়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। দেশের মানুষ রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১০টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত ১ মিনিট দাঁড়িয়ে সব আলো নিভিয়ে একসঙ্গে নীরবতা পালন করবে। তবে কেপিআই ও জরুরি স্থাপনা এ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে।
দিবসটি উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এক বাণীতে বলেছেন, ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ সারাদেশে বিশ্বের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। তিনি সেই কালরাতের সব শহীদকে স্মরণ করে বলেন, নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞে জাতি আজও শোকাহত।
একাত্তরের মার্চজুড়েই অশান্ত ছিল পুরো দেশ। এর মধ্যে ২৫ মার্চ সকাল থেকেই অজানা শঙ্কায় দিন কেটেছে বাঙালির। সেদিন বন্ধ করে দেওয়া হয় বেতারের প্রচার। সরকারি কোনো ঘোষণাও প্রচারিত হয়নি। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত অবধি মিছিল-মিটিং-স্লোগানে মুখর প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাবাসীর প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রথম রাস্তায় নেমে আসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তারা প্রথমে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পরে একে একে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ধানমন্ডি ও পিলখানা পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) সদরদপ্তরসহ রাজধানীর সর্বত্র আক্রমণ চালিয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। একই সময়ে তাদের নিধনযজ্ঞ চলে চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি বড় শহরেও।
অথচ তখনও শেখ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকসহ স্বাধীনতার দাবিতে বাঙালির বিক্ষোভে উত্তাল জনপদের খবর সংগ্রহ করতে ঢাকায় আসা বিদেশি সাংবাদিকরা অবস্থান করছিলেন শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। এ হোটেলের ১২ তলায় দেহরক্ষীদের কড়া পাহারায় ঘুমাচ্ছিলেন পাকিস্তানি পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলি ভুট্টো। রাত পৌনে ১২টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা হোটেলটি ঘিরে কেউ বেরোলেই গুলির নির্দেশ দেয়। এভাবেই বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় ঢাকাকে।
গবেষকরা বলছেন, ২৫ মার্চ এক রাতেই ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় ৫০ হাজার নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করেছে পাকিস্তান বাহিনী। অবশ্য এ পরিস্থিতিতেও রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বাঙালি ছাত্র-জনতা। কারণ, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগমুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
শুরু হয় বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চ-পরবর্তী ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা করা হয় ৩০ লাখ মানুষকে। ধর্ষিত হয় সাড়ে তিন লাখেরও বেশি নারী।
নানা কর্মসূচি
দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গত রোববার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আজ মঙ্গলবার সারাদেশে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে ২৫ মার্চ গণহত্যার স্মৃতিচারণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। এসব কর্মসূচি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার প্রচার করবে।
শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বাদ জোহর বা সুবিধাজনক সময় দেশের সব মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য উপাসনালয়েও প্রার্থনা করা হবে।
এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কালরাত স্মরণে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জাদুঘরের শিখা চিরন্তন প্রাঙ্গণে মোমবাতি প্রজ্বালন, নাট্য সংগঠন বিকেল সাড়ে ৪টায় গণহত্যা স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বর থেকে ফুলার রোডের স্মৃতি চিরন্তন চত্বর পর্যন্ত ‘লালযাত্রা’র পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন আলাদা কর্মসূচি পালন করবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সন্ধ্যা ৭টায় আলাদাভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনে ‘আলোক প্রজ্বালন ও শপথ’ কর্মসূচির আয়োজন করেছে। জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল বিকেল ৪টায় রাজধানীর তোপখানা রোডে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা করবে।
খুলনা গেজেট/এনএম