খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

সারদা ট্রেনিংয়ে এক বছর

এ এম কামরুল ইসলাম

প্রতিদিন ভোর চারটায় ওস্তাদের হাঁকডাক আর বাঁশীর ঝাঁঝালো আওয়াজে ঘুম ভাঙে। তখন ছিল শীতকাল। সকাল বেলা চারদিকে কুয়াশায় ঢাকা। পদ্মার পাড়ে যতদূর চোখ যায় ততদূর কুয়াশা। কানে শুধু শোনা যায় লেফট্ রাইট লেফট্। কুয়াশার মাঝেই সারদার মাঠ ট্রেনিজ দ্বারা ভরপুর হয়ে যায়। সব দল রেডি করার পর পিটি কমান্ডার কুয়াশার ভিতর থেকে চিৎকার করে বলেন, “পিটি শুরু করতে পারি কি, স্যার।” আবার এক দরাজ কন্ঠে কুয়াশা ভেদ করে কোথা থেকে যেন ভেসে আসে, “Carry on, as per programme.”

তারপর প্রতিটি প্লাটুনের ওস্তাদের ভিন্ন ভিন্ন কমান্ডের আওয়াজ সমগ্র সারদার প্যারেড গ্রাউন্ড মাতিয়ে রাখে। পিটি শেষ করার পর লাইন দিয়ে ব্যারাকে নিয়ে যায়। সেখানে সবার বিছানার পাশে সকালের নাস্তা দেয়া থাকে। কোনমতে নাস্তা খেতে খেতে পিটি ড্রেস পাল্টে প্যারেডের পোশাক পরতে হয়। তারপর আবার একইভাবে প্যারেড গ্রাউন্ডে গিয়ে কঠিন প্যারেড। সেখান থেকে ব্যারাকে ফিরে দ্রুত গোসল করে আবার আইনের ক্লাসের পোশাক পরে সেখানে দীর্ঘ সময় পড়াশুনা করার পর দুপুরের খাবার বিরতি। দুপুরের খাবার খেয়ে আবার বিকালে প্যারেড অথবা খেলা। সেখান থেকে সন্ধ্যায় ফিরে এসে আবার রাতে আইন কিম্বা অন্যান্য ক্লাস। প্রতিরাতে দীর্ঘক্ষণ রোল কলের নামে কঠিন আদেশ নির্দেশ শুনতে শুনতে এক প্রকার লোহার মত শক্ত মানুষে পরিণত হতে হয়। মাঝে মাঝে সিডিআই সাহেবের সামনে নিয়ে আরো বেশি সময় ধরে দীর্ঘ বক্তৃতা শুনতে হতো। সিডিআই জনাব আব্দুল মজিদ সাহেবের দীর্ঘ বক্তব্য শুনে তাঁকে বাঘের চেয়ে বেশি ভয় পেতাম। তিনি ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন রাশভারি মানুষ।

ন’টা থেকে দশটার মধ্যে রাতের খাবার। তারপর ঘুম। এভাবেই কেটে যায় পুরা একটি বছর। ট্রেনিং এর শেষ পর্যায়ে ডিসেম্বর মাস জুড়ে পরীক্ষা আর পরীক্ষা। ফেল করলেই সর্বনাশ। সবাই চলে যাবে, কিন্তু ফেল পার্টিকে বিভিন্ন মেয়াদে আটকে রেখে পুনরায় পরীক্ষা নিয়ে সকল বিষয়ে পাশ করার পর ছাড়া হয়। পরীক্ষায় পাশ করা ছাড়া আরো অনেক কারণে আটকে রাখা হয়। যেমন, বেশি বেশি অসুস্থতাজনিত ছুটিতে থাকা, ট্রেনিং চলাকালে নিয়ম ভঙ্গ করা ইত্যাদি।

চার মাস ট্রেনিংয়ের পর সারদা ছেড়ে চলে যাওয়া

পুলিশের চাকরি করা নিয়ে শুরু থেকেই দ্বিমত ছিল। ইতিমধ্যে সারদা ট্রেনিং গায়ে সয়ে গেছে। হঠাৎ একদিন আমার একমাত্র ছোটবোন পারুল, সারদা পুলিশ একাডেমিতে হাজির হলো। সে মূলতঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল। সেখানে যাবার পর বাড়িতে মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে আমার কাছে যায়। আমাকে বলার পর আমি কতৃপক্ষের কাছে পাঁচ দিনের ছুটির আবেদন করি। সেদিন পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল স্যার ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ছিলেন জনাব সাজ্জাদ হোসেন স্যার। তিনি আমার ছুটি মঞ্জুর না করে এক প্রকার তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলেন। আমার ভীষণ মন খারাপ হলো। তাই দুপুরের খাবার খেয়ে আমার বোনকে নিয়ে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি চলে গেলাম।

দুই দিন পর আবার ডুমুরিয়া থানার দারোগা সাহেব বাড়িতে হাজির হলেন। এবার তিনি রেগেমেগে রীতিমত আগুন। সেই রাশভারী ডিআইজি সাহেব বলে দিয়েছেন, আমাকে জোর করে ধরে সারদায় নিয়ে যেতে। মা বললেন, “তোমার এমএ পরীক্ষা দেবার কি হবে। সারদা থেকে পরীক্ষা দিতে পারবে তো?”
এ ব্যাপারে আমি তখনও নিশ্চিত ছিলাম না। তাই মাকে সদুত্তর দিতে পারলাম না। ওদিকে দারোগা সাহেব পারলে আমাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যায়।

ঐদিন আর এক ঘটনা ঘটে গেল। আমার ছোট বেলার বন্ধু, সহপাঠী চাচাতো ভাই গফফারের বাবা মারা গেলেন। এতে দারোগা সাহেব সদয় হয়ে এবং আমার মায়ের অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে দুই দিন বাড়ি থাকার পর সারদায় যোগদানের পরামর্শ দিলেন। আমার পক্ষ নিয়ে তিনি তার মত করে ডিআইজি সাহেবের কাছে এবং সারদা পুলিশ একাডেমিতে বেতার বার্তা দিলেন। ইতিমধ্যে গ্রামের লোকজন ও আত্মীয় স্বজনরা মিলে আমাকে পুনরায় সারদায় যোগদানের অনুরোধ করলেন। কিন্তু আমি সারদার নিয়ম কানুন তখন জেনে গেছি। সেখানে গেলে যে নিশ্চিত আমাকে শাস্তি দিয়ে দেবে এবং গাট্টি বোচকা বেঁধে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে তা আমার জানা ছিল। তবুও সবার অনুরোধে আবার সারদায় যোগদানের উদ্দেশ্যে রাজশাহী গিয়ে প্রথমে ইউনিভার্সিটির হলে গেলাম। রাতের বেলায় শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সোলায়মান মন্ডল স্যারের বাসায় গিয়ে সব কথা খুলে বললাম। তিনি সব কথা শুনে আমাকে রাতে বাসায় খাওয়ালেন। তারপর সারদার প্রিন্সিপাল স্যারকে ফোন করে আমার কথা খুলে বলে আমাকে বললেন, “তুমি কাল সকালে সারদা যেয়ে সরাসরি প্রিন্সিপাল সাহেবের কাছে রিপোর্ট কর।”

কিন্তু একজন প্রশিক্ষণরত ক্যাডেটের পক্ষে সারদার প্রিন্সিপাল সাহেবের সাথে সরাসরি দেখা করা কত কঠিন তা আমি এই চার মাসে জেনে গিয়েছিলাম।

তবুও স্যারের কথামতো আমি পরদিন সারদা গেলাম। আমার ব্যাচমেটরা আমাকে অনেক সান্ত্বনা দিতে লাগলো। ওদের মধ্যে আমার খুব ঘনিষ্ঠ, আনোয়ার অনেক বুঝাতে লাগলো। কিন্তু আমি চাইছিলাম, আমার বিছানাপাতি, কাপড় চোপড় নিয়ে সারদা ছেড়ে আসতে৷ তখন আনোয়ার বললো, “মিয়া, চাকরি কি ছেলের হাতের মোয়া? তুমি এই চাকরিতে না আসলে অন্য একটা ছেলে তোমার জায়গায় আসতো। তুমি যদি এখন চলে যেতে চাও তাহলে তোমাকে দোতলার ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেবো। কারণ, তুমি এভাবে চলে গেলে আমাদেরও মন ভেঙে যাবে। ”

এরমধ্যে ওস্তাদ খবর পেয়ে ব্যারাকে এসে ব্যাঘ্রমূর্তি ধারণ করে আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে সিডিআই সাহেবের কাছে নিয়ে আসামির মত হাজির করলেন। তিনি আমাকে আচ্ছামতো বকাঝকা শুরু করলেন। আমি যত প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে নিতে বলি, বকার মাত্রা তত বাড়তে থাকে। তবুও নিয়ম অনুযায়ী এক পর্যায়ে আমাকে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে নিয়েই গেলেন।

প্রিন্সিপাল স্যার সবাইকে রুম থেকে বের করে দিয়ে আমার সব কথা শুনলেন। ইতিমধ্যে খুলনা থেকে ডিআইজি স্যার একটা বেতার বার্তা পাঠিয়েছেন বলে প্রিন্সিপাল স্যার জানালেন। এক পর্যায়ে প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, “যাও, তোমাকে মাফ করে দেয়া হলো। এরপর আর কখনও এমন করবে না। কোন সমস্যা হলে সরাসরি আমাকে বলবে। আমি ঐদিন সারদায় হাজির থাকলে তোমাকে অবশ্যই ছুটি দিতাম।”

এই সুযোগে স্যারকে বললাম, সামনে আমার এমএ পরীক্ষা আছে। চাকরিতে আসার আগে ও এবার বাড়িতে যাবার পর মা বলেছেন, এমএ পরীক্ষা দিতে না পারলে সারদা ছেড়ে আবার ইউনিভার্সিটিতে যেয়ে ক্লাশ করতে।

লেখাপড়ার প্রতি আমার মায়ের আগ্রহের কথা শুনে তিনি বললেন, “সারদার নিয়ম অনুযায়ী আমি তোমাকে এমএ পরীক্ষার লিখিত অনুমতি দিতে পারি না; তবে তুমি গোপনে সবকিছু ম্যানেজ করে পরীক্ষা দিও। আমি তোমার পক্ষে থাকবো।”

আমি স্যারকে স্যালুট করে চলে এলাম। প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের বাইরে থাকা সকল অফিসার বিস্মিত হলেন। ব্যারাকে ফিরে এলে সব কথা শুনে সকল বন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠলো। এক প্রকার সকল নিয়ম ভেঙে আমি সারদা ট্রেনিংএ বহাল রয়ে গেলাম। চলবে…

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)

খুলনা গেজেট/ এস আই




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!