খুলনা, বাংলাদেশ | ১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৬ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম মারা গেছেন
  ভারতে হাসপাতালে আগুন লেগে ১০ শিশুর মৃত্যু

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি : ভাতা কেউ পাচ্ছেন, কেউ পাচ্ছেন না

গেজেট ডেস্ক

‘আইজ তিন-চার মাস থাকি মোর ভাতা বন্ধ, বাড়িত বসি থাকি। এই বয়সে কামকাজ করবের পাই না, খুব অভাবে চলছে।’ এভাবেই বলছিলেন কুড়িগ্রামের যাত্রাপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নসুর আলী।

শুধু কুড়িগ্রামের নসুর আলী নন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় কয়েক মাস ধরে সরকারের সামাজিক কর্মসূচির ভাতা পাচ্ছেন না উপকারভোগীরা। সম্প্রতি টাকা দেওয়া শুরু হলেও কেউ পেয়েছেন, কেউ পাননি। ফলে প্রতিবন্ধী এবং বয়স্ক মানুষ পড়েছেন বিপাকে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় প্রকৃত উপকারভোগী নির্বাচন করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

মাঠ পর্যায়ে অনেক জনপ্রতিনিধি না থাকায় প্রকৃত ভাতাভোগীর তালিকা চূড়ান্ত করতে খেই হারাচ্ছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। কারণ, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে অনেক জনপ্রতিনিধি এলাকায় নেই। প্রতিদিনই শত শত মানুষ ভাতার খবর নিতে আসেন নিজ নিজ স্থানীয় চেয়ারম্যানের দপ্তরে। কোনো সদুত্তর না পেয়ে তারা বাড়ি ফেরেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। দীর্ঘ চার মাস ভাতার টাকা না পেয়ে কষ্টে আছেন উপকারভোগীরা।

ভাতা বন্ধে কষ্টে মানুষ

রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দপ্তরে ভিড় করছেন ভাতাভোগীরা। সম্প্রতি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দপ্তর থেকে সুবিধাভোগীর কার্ড, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ কাউন্সিলরের দপ্তরে হাজির হতে নোটিশ ও মাইকিং করা হয়েছে। সুবিধাভোগীর বেশির ভাগই নির্ধারিত তারিখের নির্দিষ্ট সময়ে হাজিরও হয়েছেন। তবে কী কারণে হাজির হতে নোটিশ করা হয়েছে, তা তারা জানেন না। ফলে ভাতা না পেয়ে ফিরে যান ভুক্তভোগীরা।

কুড়িগ্রামের যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ার চরের বাসিন্দা তাহের আলী বলেন, ‘চার-পাঁচ মাস থাকি বয়স্ক ভাতা বন্ধ ছিল। আজ তিন দিন হয় টাকা পাইছি। কিন্তু হামার বউয়ের বয়স্ক ভাতার টাকা এখনও পাইনি। সংসারে ৮ ছেলেমেয়ে থাকলেও সবাই জুডা খায়, হামরা এই ভাতার টাকা দিয়া দুইজনে চলি।’

কুড়িগ্রামের উলিপুর পৌরসভার বলদিপাড়া গ্রামের প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী মর্জিনা বেগম বলেন, ‘পাঁচ মাস থাকি ভাতার টেকা পাংনা। আকালও পড়ছে, হামরা কেমন করি চলি? চাউল-তরকারির দাম বেশি, না খায়য়া থাকা নাগে।’ কুড়িগ্রামের থানাহাট ইউনিয়নের পুঁটিমারী এলাকার জহিরন বেগম জানান, আগে তিনি নিয়মিত বয়স্ক ভাতা পেতেন। এই মাসে টাকা ঢোকেনি। পরে অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তাঁর নাম নেই।

দিনাজপুর সদরের আউলিয়াপুর এলাকার ছবেদা খাতুন সর্বশেষ বয়স্ক ভাতা পেয়েছেন জুনে। এর পর আর কোনো ভাতার টাকা ঢোকেনি। অথচ তিন মাস অন্তর বয়স্ক ভাতা পেতেন তিনি। একই এলাকার মোকাররম হোসেনও বয়স্ক ভাতার টাকা পাননি। তিন মাস অন্তর বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, ভিক্ষুক পুনর্বাসনের টাকা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও এবার তা পাঁচ মাসে পড়েছে। তবে এই টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় দিনাজপুরের প্রায় দুই লাখ মানুষ কষ্টে আছেন। যদিও সমাজসেবা কর্মকর্তারা বলছেন, তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ভাতার টাকা আসতে দেরি হচ্ছে।

দিনাজপুর জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এমদাদুল হক প্রামাণিক বলেন, ‘আমরা নির্ভুলভাবে একটি তালিকা প্রস্তুত করেছি, যাতে সঠিক মানুষ উপকৃত হয়। এ জন্য একটু দেরি হচ্ছে।’

সিলেটের বিয়ানীবাজার পৌর শহরের কসবা গ্রামের বাসিন্দা রাজিয়া বেগম। ৬৫ বছর বয়সী এই বিধবা নারী চার মাস ধরে বয়স্ক ভাতা পান না। কেন পান না, তার কারণ জানেন না তিনি।

কেন এই ভোগান্তি

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগী নির্বাচন নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ তালিকায় সচ্ছল ব্যক্তিরাও ঢুকে পড়েছেন। যারা ভাতা পাওয়ার যোগ্য নন, তারাও পাচ্ছেন। অথচ প্রকৃত উপকারভোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় এ রকম সচ্ছল ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে প্রকৃত উপকারভোগীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে যারা এখন ভাতাভোগীর তালিকায় আছেন, তারা আসলেই ভাতা পাওয়ার যোগ্য কিনা, তা দেখতে বলা হয়েছে। তবে নতুন তালিকা তৈরি করার সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের পাশাপাশি সরকারের বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ (নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, অর্থ মন্ত্রণালয়) সম্পৃক্ত। তাই সবার মধ্যে সমন্বয় করে তালিকা চূড়ান্ত করতে সময় লাগছে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় নতুন তালিকা চূড়ান্ত না হওয়ায় এই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ভাতা দেওয়া হয়নি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বাজেটে ভাতাভোগীর জন্য ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের ভাতা একসঙ্গে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দেওয়া হয়। দেশের ১ কোটি ২১ লাখ উপকারভোগী এই ভাতা পেয়ে থাকেন। এবার কেউ ভাতা পেয়েছেন, কেউ পাননি।

জানা গেছে, ভাতাভোগীর তালিকা নির্ধারণে যে নীতিমালা, তাতে বলা হয়েছে– প্রতিটি ভাতা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। কমিটিতে জনপ্রতিনিধিকে সভাপতি হিসেবে রাখা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর অনেক জনপ্রতিনিধি অনুপস্থিত রয়েছেন। স্থানীয়রা বলছেন, অনেকেই রাজনৈতিক কারণে মামলায় পড়েছেন, আবার কেউ একই কারণে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফলে জটিলতা তৈরি হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কার্যক্রমের আওতায় ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে। কবে নাগাদ এই জটিলতা কাটবে, তা জানেন না কেউই।

ইউনিয়ন পর্যায়ে এ কমিটি না থাকলে বিকল্প কী হতে পারে, তা নীতিমালায় বলা আছে। সেখানে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে সভাপতি করা আছে। তবে এই তথ্য জানেন না অনেকে। ফলে উপকারভোগীর তালিকা করতে দেরি হচ্ছে। অন্যদিকে, আট জেলায় নেই জেলা প্রশাসক (ডিসি)। ওই জেলাগুলোতেও ভাতাভোগীর তালিকা তৈরিতে জটিলতা দেখা দিয়েছে। ফলে আটকে আছে পুরো কার্যক্রম।

এ ব্যাপারে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় কোনো ভাতা বন্ধ হয়নি। ভাতাভোগীর একটি স্বচ্ছ তালিকা তৈরির কাজ চলছে। মাঠপর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও জনপ্রতিনিধিরা না থাকায় তালিকা চূড়ান্ত করতে সময় লেগেছে। তাই এবার প্রথম প্রান্তিকের ভাতা দিতে কিছুটা দেরি হয়েছে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে তালিকা চূড়ান্ত করে ভাতা দেওয়া শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবাই পাবেন।

সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর মাথাপিছু মাসিক ৬০০ টাকা হারে বয়স্কভাতা পাচ্ছেন ৬০ লাখ ব্যক্তি। মাথাপিছু ৫৫০ টাকা হারে বিধবা ভাতা পান প্রায় ২৮ লাখ। মাথাপিছু ৮৫০ টাকা হারে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পান ৩২ লাখ। মাথাপিছু ৬০০ টাকা হারে হিজড়া জনগোষ্ঠীর বিশেষ ভাতা পান ১৩ লাখ। মাথাপিছু ৫০০ টাকা হারে বেদে জনগোষ্ঠীর ভাতা পান ৬ হাজার জন। মাথাপিছু ৫০০ টাকা হারে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বিশেষ ভাতা পান ৬০ হাজার। সাধারণত তিন মাস অন্তর উপকারভোগীর ভাতার টাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মোবাইল ফোনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা যায়, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর তালিকার ৪৩ শতাংশেই ত্রুটি আছে। অর্থাৎ, তারা ভাতা পাওয়ার অযোগ্য। অনেক সচ্ছল ব্যক্তির নাম এই তালিকায় রয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় একই ধরনের চিত্র উঠে এসেছে। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, উপকারভোগীর মধ্যে নিজেদের বয়স্ক দাবি করা প্রায় ৩০ শতাংশ, বিধবা দাবি করা প্রায় ৩৩ শতাংশ এ ভাতা পাওয়ার অযোগ্য।

 

খুলনা গেজেট/এইচ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!