একাত্তরে স্বাধীনতার প্রশ্নে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ঐক্যমতে পৌঁছায়। দ্বিতীয়বারে জাতি একমত পোষণ করে জে. এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি ছিল ঐক্যমতের গড়ে ওঠার ভিক্তি। এ দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল, বিএনপির নেতৃত্বে সাত দল ও জামায়াতে ইসলামী যুগপৎ আন্দোলন করে সরকারের পতনের লক্ষে। এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, শ্রমিক কর্মচারী পরিষদ- স্কপ ও বিভিন্ন কৃষক সংগঠন।
সেনা প্রধান জে. এইচ এম এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আঃ সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। তার ক্ষমতা দখলের এক বছর পর ১৯৮৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস উপলক্ষে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শিক্ষা ভবন ঘেরাও করে। সেদিন পুলিশের গুলিতে ৫ জন শহীদ হন। আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। গড়ে ওঠে ১৫ দল ও সাতদলীয় জোট।
দেশব্যাপি তীব্রতর হয় এরশাদ পতনের একদফা আন্দোলন। পাশাপাশি দাবি তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। সামরিক সরকার এরশাদ ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেন। আন্দোলনরত আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ইসলামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সংসদের মেয়াদ ছিলো চার বছর। ১৯৯০ সালে সরকার চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে।
এ নির্বাচনে আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বে জাসদ ছাড়া আর কেউ অংশ নেয়নি। ১৯৮৬ ও ৮৮ সালে জাপা সরকার গঠন করলেও জনমত গঠন করতে পারেনি।
দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের পর থেকে আন্দোলন তীব্রতর হয়। এরমধ্যে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেনের আত্মহুতি ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ডা. সামসুল আলম মিলনের আত্মহুতি ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে।
এ প্রেক্ষাপট এবং সৈনিক জীবনের ওপর ভিক্তি করে মেজর জেনারেল (অব) মনজুর রশীদ খান তার ‘আমার সৈনিক জীবন’ নামে একটা গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি প্রথমেই রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের, পরবর্তীতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদ এর সামরিক সচিব ছিলেন। তিনি এ গ্রন্থে উল্লেখ করেন ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা ও সান্ধ্য আইন জারি করে। এরমধ্য দিয়ে রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। সরকার জরুরি আইন ও কার্ফু জারি করলো তা কার্যকর করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর ঢাকার রাজপথ দখল করে। সেনা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূর উদ্দিন সরকারকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেননি। তৎকালীন ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদ পালিয়ে বিদেশে চলে যেতে চেয়েছিলেন। অবশেষে ৪ ডিসেম্বর এরশাদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়।
এরশাদের ধারণা ছিল জাপার রাজনীতিকরা তার পাশে থাকবেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ, প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ ও যোগাযোগ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ মন্ত্রীসভার কেউই এরশাদকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেননি। শেষমুহুর্ত এরশাদ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নানা কূটকৌশল আটতে থাকেন। কিন্তু ঢাকার রাজপথে জনতার মিছিল দেখে সামরিক জান্তা এরশাদ পদত্যাগের তারিখ ৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত করেন।
১৫ দল ও ৭ দল সুপ্রিম কোটের প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন। দুপুর দুইটা চল্লিশ মিনিটে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণ করে। শপথের পর নিরবে এরশাদ শপথস্থল ত্যাগ করেন।
জে. এরশাদের নয় বছরের ঘটনাবহুল ও বিতর্কিত শাসনের অবসান হয়।