সুলতানা পারভিন লাভলী দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা একজন জাতীয় ও গুণী এ্যাথলেটিক। খেলোয়াড়ী জীবনে ৭ বার দেশের দ্রুততম মানবীর খেতাব অর্জন করেছেন। কৃর্তিমতি এই নারী ক্রীড়াবিদ জাতীয় পর্যায়ে ৪৫টি স্বর্ণপদক অর্জনসহ ২৫টি আন্তর্জাতিক গেমসে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এছাড়াও আঞ্চলিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসংখ্য পদক, সম্মাননা পেয়েছেন। ২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৯ সালে মাস্টার্স এ্যাথলেটিক্সের বিভিন্ন মিটে অংশ নিয়েও অর্জন করেছেন একাধিক স্বর্ণ পদক। ক্রীড়াক্ষেত্রে তার গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৬ সালে তাঁকে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্থা এবং টেলিভিশন চ্যানেলের বিভিন্ন প্রোগ্রাম থেকে অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন কৈশোর থেকে অদম্য মানসিক শক্তিসম্পন্ন লাভলী।
খুলনা গেজেটের এ প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় সুলতানা পারভীন লাভলী অজোপাড়া গাঁয়ের রক্ষণশীল পরিবারের বাবার অপছন্দের কন্যা সন্তান হিসেবে দারিদ্রতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কিভাবে দেশসেরা একজন জাতীয় ক্রীড়াবিদ হয়ে উঠলেন সে গল্পই শোনালেন।
সুলতানা পারভীন লাভলী বলেন, এ পর্যায়ে উঠে আসার গল্পটা খুব সহজ ছিল না। খুবই কঠিন এবং সংগ্রামী ছিলো। ৩ বোন ১ ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার বড় সন্তান ছিলাম। বাবা মোঃ হাবিবুর রহমান মুন্সি কন্যা সন্তান পছন্দ করতেন না। পৃথিবীতে আগমনের পরেই আমার হোঁচট খাওয়া। জন্মের পর নাকি মা আমাকে ধরেই ফেলে দিয়েছে এই বলে “সরো আমার কাছ থেকে”। কারণ আমার জন্মের সময় মা’র বয়স ১৪/১৫ বছর। অল্প বয়সে বাচ্চা নেওয়ার কারণে বাচ্চার প্রতি সেই টানটা উনার তখন তৈরি হয়নি। পরবর্তীতে হয়েছে। যাইহোক, মা ছাড়া তেরখাদার শেখপুরায় নানি এবং খালার কাছে ৭ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষ হয়েছি। দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি শেখপুরায়। এরপর বাবা আমাকে নিয়ে আসলেন খুলনার তেরখাদা উপজেলার আজগড়া গ্রামে আমাদের বাড়িতে। আজগড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশোনো করাকালীন সময়ে আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। বাবা খুলনার বড় বাজারে রড সিমেন্টের ব্যবসা করতেন। সেগুলোও চলে যায়। আমাদের বিলে কিছু জমি ছিলো। বাবা ওটাতে হাল চাষ করবেন। কিন্তু হাল চাষ করবেন এমন দুইটা গরু নেই। ১টা গরু ছিলো। একটা গরুর সাথে তো জোড় লাগে। লোক দিয়ে কাজ করাবে সেই এবিলিটিও নেই। বাবাকে বললাম আমি তোমার সঙ্গে মাঠে যেয়ে হাল চাষ করবো। নাঙ্গলের একপাশে গরু আর অন্যপাশ আমি ধরবো। বাবা রাজি হয়ে গেলো। কারণ উনিতো কন্যা সন্তান পছন্দ করেন না। আমার প্রতি উনার কোন মায়াও ছিলো না। ওনাকে খুশী করার জন্যই মূলত আমার বিলে হাল চাষ করতে যাওয়া। এরপর বিলে যেয়ে নাঙ্গলের একপাশে আমি আর অন্য পাশে গরু, বাবা জোয়াল ধরতেন। জমিতে ধান হওয়ার পর ক্ষেত নিংড়িয়েছি। ধান কেটেছি, গরু দিয়ে ধান মাড়াই করেছি। ধান মাথায় করে বাজার থেকে ভাঙ্গিয়ে এনেছি।
আমার পরের যে ভাইটা ছিলো ওকে দিয়ে বাবা কোন কাজ করাতেন না। কারণ ও তো ছেলে, বংশের প্রদীপ। বংশের চেরাগ (বাঁতি) জ্বালাবে। এর মধ্যে স্কুলের স্পোর্টস হবে। নাম দিলাম। ১০০ মিঠার দৌঁড় হবে। তখন ১০০ মিটার কাকে বলে জানি না। শুধু এইটুকু জানি এই দিক থেকে দৌড় হয়ে ওই দিকে শেষ হবে। আমি স্কুলের বাছাইয়ে ‘খ’ গ্রুপে পড়লাম। এরপর দৌঁড় শুরু হলো। সবার আগে দৌঁড়ে গেলাম। তখন থেকে স্কুলের সবাই আমাকে চিনে গেলো। এমনকি ‘খ’গ্রুপের ছেলেদের সাথে দৌঁড় দিলেও আমি ফার্স্ট হতাম। স্কুলে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে গেলো। এরপর থেকে আশেপাশের যে কোন এলাকায় এবং খুলনার যেকোনো জায়গায় স্পোর্টস হবে শুনলে আমি আমার ফুফাতো ভাইয়ের সাইকেলের পিছনে বসে চলে যেতাম। মাঠে নেমে দৌঁড় দিলেই আমি ফার্স্ট। এরপর থেকে দৌঁড়ের প্রতি আমার একটা নেশা হয়ে যায়। ভালোবাসা তৈরি হয়।
সপ্তম শ্রেণীতে যখম পড়ি একজন এসে আমাকে বললো তুমিতো ভালো দৌঁড়াতে পারো। বিজেএমসিতে একটা টিম আছে ওই টিমে দৌঁড় দিয়ে ফাস্ট হতে পারলে চাকরি হয়ে যায়। আমার একটা ছোট বোন ছিলো। অসম্ভব সুন্দরী। হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়লো। আগেই বলেছি আমার বাবা মেয়ে সন্তান পছন্দ করতেন না। মেয়ে সন্তানকে উনি বোঝা মনে করতেন। পাপ মনে করতেন। যাই হোক বাবার অবহেলা, অযত্ন আর চিকিৎসার অভাবে বোনটা মারা গেলো। এরপর থেকে আমার মনের ভিতর ভীষণ একটা জিদ ঢুকে গেলো। আমাকে একটা কিছু করতেই হবে। তখন আমি ওই লোকটার কথামতো আমার ওই ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গে খুলনার খালিশপুর ক্রিসেন্ট জুট মিলে বিজেএমসিতে খুলনা অঞ্চলের বাছাই পর্বের খেলায় অংশগ্রহণ করলাম। গেঞ্জি পরে প্রতিযোগিতায় অংশ নিবো সে ধরনের একটা গেঞ্জিও ছিল না। ফুফাতো ভাই পাশের বাড়ির একজনের কাছ থেকে একটা গেঞ্জি চেয়ে আমার জন্য নিলো। মাঠে যেয়ে দেখি অন্য মেয়েরা কাঁটাওয়ালা জুতো (রানিং সু) পরে, ড্রেস পরে (ট্র্যাকসুট) প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এসেছে। ওসব দেখে মন কিছুটা খারাপ হলেও অদম্য সাহস আর মনোবল নিয়ে খালি পায়ে ওদের সঙ্গে দৌঁড় দিয়ে ফার্স্ট হয়ে গেলাম। ক্রিসেন্ট জুট মিলের মাঠে তখন প্রচুর দর্শক হতো। দর্শকরা আমার দৌঁড় দেখে পিচ্চি পিচ্চি বলে সবাই চিৎকার করতে লাগলো। বিজেএমসি’র কর্মকর্তারা বলাবলি করছে এ পিচ্চি কোথা থেকে এলো? নতুন আগমন।
৮ম শ্রেণীতে যখন পড়ি তখন আঞ্চলিক পর্যায়ে ফার্স্ট হওয়ার পর বিজেএমসিতে শ্রমিক হিসেবে একটা জব দেওয়া হয়। এরপর গ্রামের বাড়ি তেরখাদার আজগড়া গ্রাম থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে প্রাকটিস করতে যেতাম। ওখানে আসতে হলে বাড়ি থেকে রাত ৩টায় রওনা দিয়ে সকাল ৬টায় পৌঁছাতাম। বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথমে ভ্যানে করে যেতে হতো। তারপর নদী পার হয়ে রিকশায়। সর্বশেষ স্কুটারে করে আবু নাসের স্টেডিয়ামে পৌঁছাতাম। দুপুর পর্যন্ত প্র্যাকটিস করে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে দুপুর ১টা বেজে যেতো। বাড়িতে যেয়ে রেস্ট করে আবার পরের দিন আসার প্রস্তুতি নিতে হতো। টানা এক বছর এভাবে কষ্ট করেছি। গ্রামের যাত্রাপথে অনেক ভ্যান চালক আমাকে নামিয়ে দিতো। তারা ভ্যানে উঠাতে চাইতো না। আমাকে ভ্যানে উঠালে অন্য যাত্রীরা ভ্যানে চড়বে না। কারণ আমি ট্রাক স্যুট পড়েছি। খারাপ মেয়ে হয়ে গেছি। আমি অন্য জগতের মেয়ে হয়ে গেছি। অনেক সময় যাত্রীরা বলতো ওকে নিলে আমরা উঠবো না। গ্রামের সমাজপতিরা হুমকি দিলেন ওই মেয়ে যদি এভাবে চলাফেরা করে তাহলে তোমাদের এক ঘরে করে দেবো। ট্রাকসুট পড়ে বাড়ি থেকে বেরোলে ছেলেরা আজেবাজে কথা বলতো। টিজ করতো। ঢিল ছুড়ে মারতো, খারাপ অঙ্গভঙ্গি করতো। আমরা যেহেতু ওখানকার স্থানীয় ছিলাম না। বাবা একটু ভীতু প্রকৃতির ছিলো। তাছাড়া বাবা এসবের কোনো প্রতিবাদ করতেন না। কারণ উনি তো মেয়ে সন্তান পছন্দই করেন না। উনি মনে করতেন মেয়ে সন্তান মানে বোঝা। লস প্রজেক্ট। এভাবে চরম একটা প্রতিকূল অবস্থার ভিতর দিয়ে আমার উঠে আসা।
তবে মা আমাকে সব সময় উৎসাহ দিতেন। সহযোগীতা করতেন, সাহস জোগাতেন। মায়ের দোয়া, সাহস এবং নিজের ভিতর প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তি জন্ম নিলো আমাকে একদিন দেশ সেরা এ্যাথলেট হতে হবে। আমাদের বাড়িতে তখন ইলেকট্রিসিটি ছিলো না। পাশের বাড়ির ব্যাটারি চালিত সাদাকালো টিভিতে অলিম্পিক গেমস দেখতাম। দৌঁড়ে ফার্স্ট হয়ে দ্রুততম মানবী হচ্ছে। এ সব দেখে আমার খুব শখ এবং ইচ্ছা হত আমিও বাংলাদেশের একদিন দ্রুততম মানবী হবো। এরপর ১৯৯২ সালে নবম শ্রেণীতে পড়াশোনা করাকালীন সময়ে সর্বপ্রথম আমি দেশের দ্রুততম মানবী হলাম। এরপর থেকে আমাকে আর পিছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি। একের পর এক সাফল্য ধরা দিয়েছে। পর্যায়ক্রমে ৭ বার দেশের দ্রুততম মানবী হয়েছি। ২৫ টি আন্তর্জাতিক গেমসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি। জাতীয় পর্যায়ে ৪৫ টি স্বর্ণপদক পেয়েছি। ২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৯ সালে মাস্টার্স এ্যাথলেটিক্সের বিভিন্ন মিটে অংশ নিয়ে একাধিক স্বর্ণ পদক পেয়েছি।
সুলতানা পারভীন বলেন, ক্রীড়া জীবনের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছি বিজেএমসি থেকে।
তিনি বলেন, আমি মনে করি বাংলাদেশে ভালো মানের এ্যাথলেট আছে। আমাদের সময় থেকে এখনকার সময় অনেক সহজ। তারা যদি ভালো পৃষ্ঠপোষকতা পায় তাহলে আমার মতো অনেক লাভলী বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে।
লাভলীর স্বামী কামরুজ্জামান সেলিমও ক্রীড়া জগতের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সাবেক জাতীয় ফুটবলার। খেলেছেন ঢাকার নামকরা সব ক্লাবে।
ব্যক্তিগত জীবনে লাভলী এক পুত্র এবং এক কন্যা সন্তানের গর্বিত মাতা। ২০১৯ সালে তার সাফল্যের অনুপ্রেরণার উৎস মা মারা যান। বাবা জীবিত আছেন। তবে শয্যাশায়ী।
জাতীয় পর্যায়ে দেশ সেরা জাতীয় ক্রীড়াবিদ হয়েও লাভলী কখনও পড়াশোনা থেকে বিচ্যুত হননি। তেরখাদা উপজেলার আজগড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেছেন। বাগেরহাট খানজাহান আলী কলেজ থেকে এইচএসসি এবং কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন দেশ সেরা এই কৃতি এ্যাথলেটার। বর্তমানে লাভলী খুলনার খালিশপুর বিজেএমসি’র সহকারী সমন্বয় কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরি করছেন।
২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের জার্জ হিসেবে কাজ করছেন দেশ সেরা এই নারী স্প্রিন্টার। কোচ হিসেবে একাধিক ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়েছেন। বর্তমানে পেশাগত জীবনের ব্যস্ততার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এ্যাথলেট তৈরির কারিগর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন এই মহীয়সী নারী।
খুলনা গেজেট/এনএম