সাতক্ষীরা সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের দাখিলকৃত পরিদর্শন ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন গত চার বছরেও কার্যকর হয়নি। ফলে তিন অর্থ বছরে কলেজে শিক্ষার্থীদের ভর্তি ও ফি বাবদ চার কোটি ৯০ লাখ ৬৮ হাজার ৬০৩ টাকা, সরকারি ২১ লাখ ৮৯ হাজার ১০০ টাকা ও ভ্যাট বাবদ এক লাখ ৪১ হাজার ৯৫ টাকা রয়ে গেছে অধ্যক্ষ আবু সাঈদসহ সংশ্লিষ্ট পকেটে।
গত ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক প্রফেসর মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন স্বাক্ষরিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ মে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ রাশেদুজ্জামানের নেতৃত্বে শিক্ষা পরিদর্শক মোঃ হেমায়েতউদ্দিন এবং প্রাক্তন অডিট অফিসার মোঃ মোকলেছুর রহমান সাতক্ষীরা সিটি কলেজটি সরেজমিনে পরিদর্শন ও নিরীক্ষণ করেন। তাদের দাখিলকৃত প্রতিবেদনে যে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতি ধরা পড়েছে তা গত চার বছরেও কার্যকর করা হয়নি। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতরা এতই প্রভাবশালী যে, সংশ্লিষ্ট দপ্তর ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পরও নীরব ভূমিকা পালন করে আসছেন।
তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সাতক্ষীরা সিটি কলেজের দর্শন বিভাগের প্রভাষক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম তথ্য জালিয়াতি করে ২০১৫ সালের পহেলা নভেম্বর এমপিওভুক্ত হন। তদন্তকালিন সময় তার দ্বারা গৃহীত ২০১৭ সালের মে মাস পর্যন্ত তিন লাখ ৭৭ হাজার ৬০ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে বলা হয়েছে। এমনকি কাম্য সংখ্যক শিক্ষার্থী না থাকায় ওই শিক্ষক ভবিষ্যতে এমপিওভুক্ত হতে পারবেন না। সিটি কলেজের উপাধ্যক্ষ মোঃ শহীদুল ইসলাম দীর্ঘ পাঁচ বছর (২০১৩ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত) ধারাবাহিকভাবে অনুপস্থিত থাকার পরও তার নামে বিল করে আর্থিক বিধি লঙ্ঘন করে টাকা তোলায় সভাপতি, অধ্যক্ষ ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক (সাতক্ষীরা রুপালী ব্যাংকের প্রধান শাখা) কর্মকর্তা দায়ী। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ওই টাকা তোলার সঙ্গে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তদন্ত কমিটি সুপারিশ করেন।
কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মোঃ মনিরুজ্জামান সাময়িক বরখাস্ত থাকাকালিন সময়ে তার বেতন ভাতা বাবদ ২৮ হাজার ২০০ টাকা ওই শিক্ষককে না দিয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করায় সংশ্লিষ্ট সকলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। কলেজের বিএম শাখার প্রভাষক মোঃ ইউনুস আলী নাশকতা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ায় ২০১৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাময়িক বরখাস্ত হন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তিনি বরখাস্ত থকেলেও এ সময় তার নামে বরাদ্দকৃত এমপিও বাবদ বরাদ্দ ১৩ হাজার ৩৪০ টাকা অধ্যক্ষ আত্মসাৎ করেন। এজন্য অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
কলেজের গ্রন্থাগারিক মোঃ কামরুল ইসলামের ২০২১সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে উচ্চতর বেতন স্কেল পাওয়ার কথা। কিন্তু অধ্যক্ষ আবু সাঈদ তথ্য জালিয়াতির মাধ্যমে ২০১৫সালের পহেলা জুলাই থেকে উচ্চতর স্কেল ২২ হাজার টাকার পরিবর্তে ২৯ হাজার টাকার বেতনের সুপারিশ করেন। ওই অবৈধ উচ্চতর বেতন স্কেল বাবদ গৃহীত এক লাখ ৬১ হাজার টাকা সরকারের কোষাগারে ফেরতের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সিটি কলেজে ডিগ্রী স্তরে কাম্য সংখ্যক শিক্ষার্থী না থাকায় সংশ্লিষ্ট বিভাগে অধিভুক্তি প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে।
এদিকে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন ও ফি আদায় করা হলেও কাগজে কলমে তার যথাযথ হিসাব রাখা হয়নি। ওই বেতন ও ফি বাবদ আদায়কৃত অর্থের রাজস্ব স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হয়নি। এজন্য রাজস্ব স্ট্যাম্প বাবদ ২৮ হাজার ৬০০ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন মালামাল ক্রয়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফাইনান্সিয়াল রুলস অনুসরণ করা হয়নি। মালামাল ক্রয়ে বা বিভিন্ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে রাজস্ব স্টাম্প ব্যবহার না করে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
অধ্যক্ষ আবু সাঈদ সাতক্ষীরা সিটি কলেজে ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি যোগদানের পর ইসলামী ব্যাংক লি: সাতক্ষীরা শাখা থেকে (হিসাব নং-২০৫০১৪৩০২০১৩১৬১০৮) ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ২৫ লাখ ৯৪ হাজার ৪৩৭ টাকা এবং ওই বছরের ২৯ মার্চ ১৫ লাখ ৫৯ হাজার ৪৭৫ টাকা তুলে আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া অধ্যক্ষ আবু সাঈদ সিটি কলেজে যোগদানের পর আইএফআইসি ব্যাংক লি: সাতক্ষীরা শাখায় অনার্সের ১৫টি বিষয়ের ১৫টি ব্যাংক একাউন্ট থেকে চেকের মাধ্যমে ৬১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৪২টাকা তুললেও তদন্তকালে ব্যয়ের কোন ভাউচার দেখাতে পারেননি তিনি। একই সাথে সোনালী ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখায় সাতক্ষীরা সিটি কলেজের হিসাব নম্বর ১০০০০৭১০ হতে চেকের মাধ্যমে তোলা ৯৭ লাখ ২৬ হাজার ৯২৫ টাকার ব্যয় এর স্বপক্ষে কোন ভাউচার দেখাতে পারেননি অধ্যক্ষ আবু সাঈদ। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে তোলা এক লাখ ৭৮ হাজার ১৭ টাকা এবং এপ্রিল মাসে তোলা এক লাখ ১৬ হাজার ৮০৫ টাকা মোট দুই লাখ ৯৪ হাজার ৮২২ টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে আর্থিক বিধি অনুসরণ করা হয়নি। শিক্ষক কর্মচারিদের বেতন বাবদ রূপালী ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখা থেকে আটটি চেক এর মাধ্যমে তোলা ৫৪ লাখ ২১ হাজার ৮৪৭ টাকার কোন বেতন বিল পাওয়া যায়নি। যা অধ্যক্ষের আত্মসাতের শামিল। আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখায় হিসাব নং- ০১১১১২০০৪০২১১ থেকে ২০১৪ সালের ৯ জুলাই ৪৫৯২০৬১ নং চেক এর মাধ্যমে ২০ লাখ এবং ওই বছরের ২৪ জুলাই ৪৫৯২০৬২ নং চেক এর মাধ্যমে আট লাখ সর্বমোট ২৮ লাখ টাকা তোলা হলেও ব্যয়ের কোন বিল বা ভাউচার দেখাতে পারেননি অধ্যক্ষ। সিটি কলেজে যোগদানের ৫দিন পর অধ্যক্ষ আবু সাঈদ রূপালী ব্যাংক লিঃ সাতক্ষীরা শাখা থেকে (চেক নং-১৩১৭৫৭৪) ১৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা তুললেও তদন্তকালে উক্ত টাকা ব্যয় সংক্রান্ত কোন বিল বা ভাউচার দেখাতে পারেননি। রূপালী ব্যাংক লিঃ সাতক্ষীরা শাখা এর হিসাব নং- ১০০০০৫৫৪০৮ হতে তদন্তকাল পর্যন্ত (০২-০৫-২০১৭) এক কোটি ৬০ লাখ ১০ হাজার ৮৮৮ টাকার বিপরীতে বেতন বিল বা ব্যয় এর কোন ভাউচার দেখাতে পারেননি। যা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
অপরদিকে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা সংক্রান্ত ব্যয় বাবদ ৬ লাখ ৩৭ হাজার ১৯০ টাকা ব্যয় এর কোন বিল বা ভাউচার দেখাতে পারেননি। প্রশাসনিক ভবনের চতুর্থতলার ৫টি রুমের বারান্দার প্লাস্টার, দরজা ও জানালা নির্মাণ বাবদ ৪ লাখ ১৩ হাজার টাকা ও রং করা ববাদ ১৭ হাজার ৯৯০ টাকা ব্যয়ে তিনি কোন আর্থিক বিধি অনুসরণ করেননি। এই নির্মাণ সংক্রান্ত ব্যয়ে সরকারের ভ্যাট বাবদ ২৩ হাজার ৭০৪ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেননি অধ্যক্ষ। এছাড়া মামুন স্মৃতি গেট নির্মাণ বাবদ এক লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং গেট উদ্বোধন ও আলোচনা সভা উপলক্ষে ২৮ হাজার টাকার কোন ভাউচার না দেখিয়ে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই নির্মাণ ব্যয়ে ভ্যাট বাবদ ৭ হাজার ৭০০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি।
এছাড়া প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আসবাবপত্র ও মালামাল ক্রয়ে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করা হলেও ওই ক্ষেত্রে আর্থিক বিধি অনুসরন করা হয়নি এবং ভ্যাট বাবদ ৭ হাজার ৭২৮ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেননি অধ্যক্ষ। হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গৃহীত দেড় লাখ টাকা থেকে ৬৫ হাজার টাকা পরিশোধ বাবদ ব্যয় দেখালেও ঋণ গ্রহণের কোন প্রমান পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সময়ে ব্যয় দেখানো তিন লাখ ৮১ হাজার ২২০ টাকার কোন ভাউচার দেখাতে পারেননি অধ্যক্ষ। রূপালী ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখা থেকে চারটি চেক এর মাধ্যমে তোলা ২৭ লাখ ৬ হাজার ৩৩৯ টাকার মধ্যে ৫ লাখ ৮ হাজার ২০০ টাকার কোন ভাউচার দেখাতে পারেননি। রূপালী ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখা থেকে ২০১৫ সালের ১৭ মে ৮০০৮৬৯১ নং চেক এর মাধ্যমে তোলা ৬ লাখ টাকার মধ্যে চার লাখ ৫৯ হাজার ৬২০ টাকার কোন ভাউচার পাওয়া যায়নি। উক্ত ব্যয়ে ভ্যাট বাবদ ৫ হাজার ৬১৫ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেননি। কলেজের নির্মাণ কাজে সিমেন্ট কেনা বাবদ ২৮ হাজার ৭০৬ টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোন আর্থিক বিধি অনুসরণ করা হয়নি। এবং ভ্যাট বাবদ ৭৯৫ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেননি। কলেজের প্রাচীর নির্মাণে মিস্ত্রী খরচ বাবদ এক লাখ ৬ হাজার ৪৬৪ টাকা বিল করলেও উক্ত টাকা প্রাচীর নির্মাণের নামে আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ ও মেঝের কাজ করানোর জন্য মিস্ত্রী বাবদ ৪৫ হাজার ৬৬১ টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে আর্থিক বিধি অনুসরণ করা হয়নি। ভ্যাট বাবদ ২৫১১ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেননি। কলেজের মামলা পরিচালনা বাবদ এক লাখ ৯৮ হাজার টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোন ভাউচার পাওয়া যাযনি। পাবলিক ও অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার সম্মানী বন্টনের ক্ষেত্রে ভ্যাট বাবদ ৭৭ হাজার ৩৮টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি।
উল্লেখ্য, তদন্ত কমিটি সিটি কলেজে তিন অর্থ বছরের বছরের (২০১৪/১৫, ২০১৫/১৬ ও ২০১৬/২০১৭ অর্থবছর পর্যন্ত) যে তদন্ত করেছেন সে সময় কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন স্থানীয় সরকার দলীয় সাংসদ মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি। তদন্ত প্রতিবেদনের কপি সিটি কলেজ পরিচালনা পরিষদের তৎকালিন সভাপতি, অধ্যক্ষ, শিক্ষা অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক, গাজীপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়।
এ ব্যাপারে সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ড. শিহাব উদ্দিন জানান, তিনি আট মাস আগে এ কলেজে যোগদান করেছেন। গত মঙ্গলবার তাকে ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মোকসুমুল হককে শিক্ষা সচীব তার অফিসে ডাকিয়েছিলেন। উপাধ্যক্ষ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা প্রতিবেদনের আলোকে তাকে যে কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়েছেন সে অনুযায়ি তিনি জবাব দিয়েছেন। প্রয়োজনে শিক্ষা সচিব মহোদয় তাদেরকে আবারো তার অফিসে ডাকবেন বলে জানিয়েছেন। তবে ওই তদন্ত চার বছরের নয়, ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত করা হয় বলে তিনি জানান। তবে সাতক্ষীরা সিটি কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মোকসুমুল হাকিমের সঙ্গে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
খুলনা গেজেট/এনএম