খুলনা, বাংলাদেশ | ২২ আষাঢ়, ১৪৩১ | ৬ জুলাই, ২০২৪

Breaking News

  জাতীয় দাবা চলাকালীন অসুস্থ হয়ে গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের মৃত্যু
  ফরিদপুরে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে চালক-হেলপার নিহত

ঘুষ ছাড়া নামজারি হয় না সাতক্ষীরা সদর ভূমি অফিসে

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

ঘুষ ছাড়া জমির নামজারি হয় না সাতক্ষীরা সদর উপজেলা ভূমি অফিসে। গ্রাহককে বিভিন্ন অজুহাতে হয়রানি করে নেওয়া হয় এ ঘুষের টাকা। কাগজপত্র ঠিক থাকলে সহকারী কমিশনার পর্যন্ত ফাইল পৌঁছাতে নিচের কয়েকটি টেবিলে গ্রাহককে দিতে হয় প্রায় ছয় হাজার টাকা। আর কাগজপত্রে কোন গরমিল খুঁজে পেলে গ্রাহককে গুনতে হয় কয়েক গুন টাকা। টাকা না পেলে সেবার জন্য দিনের পর দিন এ টেবিল থেকে ও টেবিল ঘুরতে হয় গ্রাহককে। আবার ভূমি অফিসকে কেন্দ্র করে আব্দুর রাজ্জাক, মুকুল, তৌহিদ ও জিয়াসহ একাধীক দালালের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত টাকা পেলে মুহূর্তে সব ঠিক করে দেন অফিসের সায়রাত সহকারী মিলন কুমার চক্রবর্তীসহ অন্যরা।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জমির নামজারির আবেদন থেকে শুরু করে ডিসিআর (ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ) নেওয়া পর্যন্ত প্রতি টেবিলে দিতে হয় টাকা। তবে দালালের মাধ্যমে কাজ করলে এক জায়গায় টাকা দিলেই মেলে সেবা। সরকার জমির নামজারির জন্য এক হাজার ১৫০ টাকা ফি নির্ধারণ করে দিলেও সাতক্ষীরা সদর ভূমি অফিসে গ্রাহককে গুনতে হচ্ছে কমপক্ষে ছয় হাজার টাকা। সরকার নির্ধারিত ফি বাদে অতিরিক্ত টাকা চলে যাচ্ছে অফিসের কয়েকজন কর্মচারী ও দালালের পকেটে।

ভুক্তভোগীরা জানান, জমির নামজারির জন্য অনলাইনে আবেদন করার পর অফিসের সায়রাত সহকারী মিলন কুমার চক্রবর্তীর নিকট ফাইল জমা দিতে হয়। এসময় ফাইল প্রতি দিতে হয় ৭০ টাকা। সায়রাত সহকারী মিলন কুমার চক্রবর্তী ফাইল জমা নেওয়া পর প্রতিস্বাক্ষরের জন্য ইউনিয়ন/পৌরসভা ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তার আইডিতে প্রেরণ করেন। ইউনিয়ন/পৌরসভা ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের সার্ভেয়ারের আইডিতে প্রেরণ করেন। সার্ভেয়ার কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে ফাইলটি অফিসের সায়রাত সহকারী মিলন কুমার চক্রবর্তীর কাছে প্রেরণ করেন। তিনি সকল কাগজপত্র প্রস্তুত করে উপজেলা ভূমি কর্মকর্তার আইডিতে প্রেরণ করেন। ভূমি কর্মকর্তা শুনানি শেষে নামজারির আদেশ দেন।

সেবা গ্রহীতাদের অভিযোগ, জমির নামজারির জন্য অনলাইনে আবেদন করার পর সরাসরি নিজে কাজ করতে গেলে ফাইল জমা থেকে শুরু করে ডিসিআর কাটা পর্যন্ত টেবিলে টেবিলে দিতে হয় টাকা। আবার টাকা না পেলে অফিসের দালাল আব্দুর রাজ্জাক ফাইল সরিয়ে দেন। আর দালালের মাধ্যমে টাকা দিয়ে কাজ করালে টেবিলে টেবিলে ঘুরতে হয় না। টাকা খরচ হলেও কাজ দ্রুত হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাতক্ষীরা সদর উপজেলা ভূমি অফিসকে কেন্দ্র করে আব্দুর রাজ্জাক, মুকুল, তৌহিদ ও জিয়াসহ রয়েছে বেশ কয়েকজন দালাল। দালালরা অফিসের কতিপয় কর্মচারী সহযোগিতায় গ্রাহকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করে। আবার দালালের মাধ্যমে ফাইল না গেলে অনেক সময় গ্রাহকের ফাইল সরিয়ে দেন আব্দুর রাজ্জাক। অফিসে প্রায় প্রতিনিয়তই ফাইল সরিয়ে ফেলার অভিযোগ পাওয়া যায় রাজ্জাকের বিরুদ্ধে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরাতন সাতক্ষীরা এলাকার এক ব্যক্তি জানান, ওয়ারেশ সূত্রে প্রাপ্ত জমির নামজারি করার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু নানা অযুহাত দেখিয়ে আবেদনটি কয়েক বার খারিজ করে দেওয়া হয়। পরর্বিততে ভূমি অফিসের সায়রাত সহকারী মিলন কুমার চক্রবর্তী নাম করে দালাল মুকুল সাত হাজার টাকা নেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। এখন টাকা ফেরত চাইলে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে দালাল মুকুল।

তিনি আরও জানান, পরিবর্তিতে নামজারির আবেদন পৌরসভা ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা প্রতিস্বাক্ষর করে ভূমি কার্যালয়ে পাঠালে সেখান থেকে নোটিশ জারি করা হয়। পরবর্তিতে সার্ভেয়ারকে কাগজপত্র দেখালে সব ঠিক থাকায় তাকে দিতে হয় ৩০০ টাকা। সার্ভেয়ার কাগজপত্র যাচাইবাছাই করে ভূমি কর্মকর্তার আইডিতে প্রেরণ করেন। এসময় অফিসের সায়রাত সহকারী মিলন কুমার চক্রবর্তীকে দিতে হয় এক হাজার টাকা।

রাজারবাগান এলাকার আরও দুই ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, নাম জারির জন্য অফিসে এসেছেন। কিন্তু তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। পরে সার্ভেয়ার ও সায়রাত সহকারী মিলন কুমার চক্রবর্তীকে এক হাজার করে টাকা করে মোট দুই হাজার টাকা দিলে সব ঠিক করে সাথে সাথে নাম জারির কাগজ দিয়ে দেন সদর উপজেলার মাছখোলা এলাকার এক ব্যক্তি জানান, নিজের জমির নাম জারির জন্য আবেদন করেছিলেন। আবেদনটি ইউনিয়ন ভূমি অফিসে প্রেরণ করলে সেখানে সকল প্রকার কাগজপত্র দেখানো হয়। কিন্তু ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তাকে টাকা না দেওয়ায় তিনি আবেদনটি খারিজ করে দেন। পরবর্তিতে আবারও আবেদন করা হলে এক বড় ভাইয়ের অনুরোধে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা আবেদনটি সঠিক উল্লেখ করে উপজেলা ভূমি অফিসে প্রেরণ করেন। সেখানে সার্ভেয়ারকে ২০০ এবং সায়রাত সহকারীকে এক হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে নাম জারির কাজটি করাতে সক্ষম হন। তবে এ কাজের জন্য তাকে প্রায় ১ বছর ভূমি অফিসে ঘুরতে হয়েছে বলে তিনি জানান।

আব্দুর রাজ্জাকের সাথে কথা বললে তিনি প্রথমে নিজেকে ন্যাশনাল সার্ভিসের কর্মী হিসেবে দাবি করেন। ন্যাশনাল সার্ভিস প্রকল্প বর্তমানে বন্ধ হলেও আপনি কিভাবে এখনও ন্যাশনাল সার্ভিসের কর্মী হিসেবে কাজ করছেন জানতে চাইলে তিনি কথা ঘুরিয়ে বলেন, আমি উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ নিয়েছি। উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছি।

জমির নাম জারির জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সঠিক কোন উত্তর না দিয়ে বলেন, আমি অনেক দিন যাবত এসব কাজের সাথে জড়িত। তাই কোন কাজ কোন টেবিলে করতে হবে এসব বিষয়ে গ্রাহককে সঠিক পথ দেখাই মাত্র।

অফিসের সায়রাত সহকারী মিলন কুমার চক্রবর্তী আগে আবেদন জমার সময় ৭০ টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, সরকারি নির্দেশনা মেনে এ টাকা নেওয়া হতো, তবে বর্তমানে আর নেওয়া হয় না বলে তিনি জানান।

তিনি আরও বলেন, আমার নাম ব্যবহার করে যদি কোন ব্যক্তি টাকা নিয়ে থাকে তার দায় দায়িত্ব আমি নিবো না। তবে তিনি কোন বাড়তি টাকার নেন না বলেও জানান।

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, এসব বিষয় আমার জানা ছিলো না। আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো। যদি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় তাহলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি জানান।

 

খুলনা গেজেট/এএ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!