সাতক্ষীরার চাঞ্চল্যকর কলেজ ছাত্র গৌতম সরকার হত্যা মামলার পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। মামলার চার আসামির বিরুদ্ধে আদালত ফাঁসির আদেশ দেয়। দুই আসামি পলাতক ও উচ্চ আদালতে আপিলে ঝুঁলে আছে ফাঁসির কার্যকারিতা। ফলে হুমকিতে রয়েছে নিহতের পরিবারের সদস্য।
আলোচিত এই হত্যা মামলায় আদালতের দেয়া রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা।
সোমবার (১৩ ডিসেম্বর) গৌতম সরকারের পঞ্চম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক স্মরণসভায় উপস্থিত মানুষজন আদালতের রায় দ্রুত বাস্তবায়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, বিগত ২০১৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে সদর উপজেলার ঘোনা গ্রামের বাড়ির পাশে একটি দোকানে টেলিভিশনে খেলা দেখার সময় ঘোনা ইউপি সদস্য গনেশ সরকারের ছেলে মাহমুদপুর সীমান্ত আদর্শ ডিগ্রী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র গৌতম সরকারকে মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। মুক্তিপণ না পেয়ে গালের মধ্যে গুলের কৌটা ঢুকিয়ে মুখে ক্রস টেপ মেরে হাত ও পা বেঁধে নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করে দূর্বৃত্তরা। পরে পার্শ্ববর্তী একটি নির্মাণাধীন বাড়ির পুকুরে বাঁশের খুটির সঙ্গে বেঁধে দেহে ১২টি ইট ঝুলিয়ে লাশ গুম করার চেষ্টা করা হয়।
খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে ১৫ ডিসেম্বর দেবহাটা উপজেলার বহেরা খাস খামার এলাকা থেকে একটি রামদাসহ আলী আহম্মেদ শাওন ও শাহাদাতকে আটক করা হয়। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ১৬ ডিসেম্বর গনেশ সরকার বাদি হয়ে ভাড়খালির শাহাদাৎ হোসেন, দেবহাটার বগেরা গ্রামের আলী আহম্মেদ শাওন, সদরের মহাদেবনগরের সাজু শেখ, নাজমুল হাসান, কবিরুল ইসলাম মিঠু ও মহসিন আলীর নাম উল্লেখ করে থানায় একটি অপহরণ ও হত্যা মামলা দায়ের করেন।
গ্রেপ্তারকৃত শাওনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী নাজমুল হাসান, সাজু শেখ ও মহসিনকে জনতার সহায়তায় আটক করা হয়। ১৭ ডিসেম্বর পুলিশ গৌতমের লাশ উদ্ধার করে। ওই দিন গনেশ সরকার বাদি হয়ে নুর আহম্মেদ মুক্ত, ওমর ফারুক ও জামসেদের নাম উল্লেখ করে থানায় একটি সম্পুরক এজাহার দাখিল করেন।
গ্রেপ্তারকৃত শাহাদাৎ ও নাজমুল হোসেন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক এসএম আশরাফুল শাহাদাৎ, নাজমুল, নূর আহম্মদ মুক্ত, ওমর ফারুক, সাজু হোসেন, ফজিলা খাতুন, মহসিন আলী, কবিরুল ইসলাম মিঠু, আলী আহম্মেদ শাওন ও জামসেদ আলীর নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
একে একে মামলার সকল আসামি জেল হাজতে যায়। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আবেদন করে জামিন নিয়ে আলী আহম্মেদ শাওন পালিয়ে যায়। জামিন মুক্তি পেয়ে পালিয়ে যায় সাজু শেখ।
২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ সাদিকুল ইসলাম তালুকদার আসামী শাহাদাৎ হোসেন, সাজু শেখ, নাজমুল হোসেন ও আলী আহম্মেদ শাওনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করার নির্দেশ দেন। শাওন ও সাজু পলাতক থাকলেও জেল হাজতে থাকা শাহাদাৎ ও নাজমুল মহামান্য হাইকোর্টে দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।
ছেলে স্মরণসভা অনুষ্ঠানে গণেশ সরকার বলেন, তার ছেলেকে নৃশংসভাবে হত্যার বিচারের রায় কার্যকর না হওয়ায় গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ও তার পরিবারের সদস্যরা রয়েছে উৎকণ্ঠায়। তাছাড়া হত্যা মামলা চলাকালীন আসামি শাহাদাতের মা বাদি হয়ে তার ঘরবাড়ি ভাঙচুরও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ১২জন হিন্দুর নামে মামলা করেন। মামলার ১৩ জন সাক্ষী ছিল জামায়াতের লোক। এ ছাড়া ছেলের নির্মম মৃত্যুতে নিরাপত্তাজনিত কারণে মেয়ে প্রিয়া সরকারকে কলেজে পড়া বন্ধ করে দিয়ে বিয়ে দিতে হয়েছে। তিনি নিজেও পথে ঘাটে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারেন না। এবার ইউপি নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়েছেন ছেলে হত্যা মামলার আসামিদের স্বজনদের পরিকল্পনার কারণে।
উচ্চ আদালতে বিচারের যে জট তাতে তিনি জীবদ্দশায় আসামিদের শাস্তি দেখে যেতে পারবেন বলে মনে করেন না। তবে স্বপরিবারে ভারতে পালিয়ে থাকা সাজু শেখ ও আলী আহম্মেদ শাওনকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার যদি ব্যবস্থা না নেয় তাহলে তারা কোনদিনও বিচারের আওতায় আসবে না।
ঘোনা গ্রামের নিজ বাড়িতে গৌতমের স্মৃতিচারনামূলক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঘোনা বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হিরণ কুমার বিশ্বাস, ছনকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হীরেন বিশ্বাস, কীর্তনিয়া গোবিন্দ কুমার সরকার ও কীর্তনিয়া ছোট হরিদাস প্রমুখ। তারা আলোচিত এই হত্যা মামলায় আদালতের দেয়া রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান।
খুলনা গেজেট/এএ