সাতক্ষীরায় অবৈধভাবে চলছে অর্ধশতাধিক ইটভাটা। সারাদেশে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও মানছে না কেউ। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়াপত্র ও সরকারি লাইসেন্স ছাড়াই অবৈধভাবে চলছে এসব ইটভাট। ভাটায় কয়লার সাথে কাঠ, তুষকাঠ ও টায়ার পোড়ানে কালি ব্যবহার করে ইট পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয়রা।
জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সাতক্ষীরায় ৯৬টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ঝিকঝাক ভাটা ৮৩ টি এবং সনাতনী পদ্ধতির ভাটা রয়েছে ১৩টি। এসব ভাটার মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই ৬৭টি ভাটার। ছাড়পত্র আছে মাত্র ২৯টি ভাটার। পরিবেশের ছাড়পত্র বিহীন এসব অবৈধ ইটভাটার কোন সরকারি অনুমোদন বা লাইসেন্স নেই। শুধুমাত্র উচ্চ আদালতে একটি রিটের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বছরের পর বছর অবৈধভাবে চলছে এসব ইটভাট। উচ্চ আদালতে রীট করার কারণে পরিবশে অধিদপ্তর অবৈধ এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের নজরদারি না থাকায় অবৈধ এসব ভাটায় ব্যহৃত হচ্ছে কাঠ ও তুষকাঠ এবং টায়ার পোড়ানো কালি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি উচ্চ আদালত এক আদেশে দেশের সকল অবৈধ ইটভাট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। এক রিটের প্রাথমিক শুনানী শেষে গত ১৩ নভেম্বর রোববার বিচারপতি মোঃ আশরাফুর ইসলাম ও বিচারপতি মোঃ সোহরাওয়ারদীর সমন্নয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্জ রুলসহ এ আদেশ দেন। পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে গত ১০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার উচ্চ আদালতে এই রিট করা হয়।
এদিকে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশতাধিক অবৈধ ইটভাটা পুরোদমে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় এসব অবৈধ ইটভাটায় জ্বালানি হিসাবে কয়লার সাথে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ ও তুষকাঠ এবং টায়ার পোড়ানো কালি। টায়ার পোড়ানো কালির ধোয়া ক্যান্সারের মত মরনঘাতি ব্যাধির সহায়ক। ফলে বায়ু দূষনের কবলে পড়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুকিতে রয়েছে অবৈধ এসব ইটভাটার আশেপাশে বসবাসকারি জনসাধারণ।
সরেজমিনে সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলার কয়েকটি ইটভাটায় গিয়ে দেখা গেছে সেখানে অধিকাংশ ভাটাগুলোতে কয়লার সাথে তুষকাঠ মিশিয়ে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সাথে ব্যবহার হচ্ছে কাঠ ও টায়ার পোড়ানো কালি। সদরের বিনেরপোতা এলাকায় মেসার্স রহমান ব্রিকস এ গিয়ে দেখা গেছে সেখানে ভাটার পাশে স্তুুপাকারে ফেলানো রয়েছে জ্বালানি কাঠ। পাশের একটি ঘরে রয়েছে তুষকাঠ।
এবিষয়ে ভাটার ম্যানেজার আকবর আলী বলেন, প্রথমে জ্বালাবার সময় ভাটার ভিতরে অল্প কিছু কাঠ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কয়লার দাম বেশি হওয়ায় সাথে তুষকাঠ ব্যবহার করা হয়।
মেসার্স রহমান ব্রিকসের মালিক মকসুদুর রহমান বলেন, যশোরের নওয়াপড়ার ব্যবসায়িরা সিন্ডিকেট করে কয়লায় পানি মিশিয়ে ওজন বৃদ্ধি করে। এছাড়া দামও অনেক বেশি। গত বছর আমার ভাটায় এক কোটি টাকা লস হয়েছে। ফলে এই মুহুর্ত্বে শুধুমাত্র কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানো একেবারেই অসম্ভব। তাই আমরা জ্বালানি হিসাবে কয়লার সাথে তুষকাঠ ব্যবহার করছি।
সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের নুনগোলা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, জেলা ভাটামালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ রেজাউল সরদারের মালিকানাধীন মেসার্স এম.আর.এস ব্রিকস এর চারিপাশে স্তুুপ আকের সাজানো রয়েছে জ্বালানী কাঠ। ভাটায় ঢোকার মুখে একটি বড় ঘরে সাজানো রয়েছে তুষকাঠ। এভাবে জনবসতি এলাকায় অবস্থিত তার ভাটায় জ্বালানি হিসাবে পুরোদমে কাঠ ও তুষকাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ভাটার কালো ধোয়া বায়ু দুষন করে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুকির মধ্য্যে ফেলে দিচ্ছে স্থানীয় জনসাধারণকে।
একইভাবে তুষকাঠ ও টায়ার পোড়ানে কালি ব্যবহার করা হচ্ছে সদরের গাভা এলাকার মেসার্স রকি ও জে,বি ব্রিকসে, বিনেরপোতার হাবিব ব্রিকস, এস,বি,এফ ব্রিকস, সাদিয়া ব্রিকস, বাবুলিয়ার বি,বি,ব্রিসক ও এস,বি,এল ব্রিকস, এস,কে ব্রিকস, হাওয়ালখালির রাকিন ব্রিকস ও নীম রাজি ব্রিকস, ভাদড়া মোড়ের কে,এন ব্রিকস, আশাশুনির কুল্যার মোড়ের হাজী ব্রিকস, গুনাকরকাটির রূমানা ব্রিকস ও সরদার ব্রিকস, কালিগঞ্জের গোবিন্দকাটির একতা ব্রিকস, উজিরপুরের টি,আর,বি ব্রিকস, বাজারগ্রামের শেখ ব্রিকস ও ময়না ব্রিকস, চন্ডিপুরের এস,বি-১৭ ব্রিকস,নাজিমগঞ্জের ব্রাদার্স ব্রিকস, শ্যামনগরের এ,বি,আর ব্রিকস, সোনারমোড়ের এইচ,বি ব্রিকস ও আশা ব্রিকস, খানপুরের গাজী ব্রিকস, চন্ডিপুরের গাজী ব্রিকস, দেবহাটার খানজিয়া এলাকার রুমানা ব্রিকস ও সখিপুরের ইসলামিয়া ব্রিকস এবং পাটকেলঘাটার চৌধুরী ও এস,এন,বি ব্রিকস সহ জেলার শতাধিক ইটভাটায়।
এবিষয় সাতক্ষীরা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম বলেন, জেলার ব্রিক ফিল্ড গুলো কাঠ ও তুষকাঠ পোড়ানো শুরু করেছে জানতে পেরে আমরা অভিযান পরিচালনা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। অভিযানের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠিও দিয়েছি। ইট ভাটায় কাঠ ও তুষকাঠ পোড়ানো বন্ধসহ জেলার অবৈধ ইটভাটা বন্ধে খুব শীঘ্রেই অভিযান শুরু করা হবে।
জেলায় অর্ধশতাধিক অবৈধ ইটভাটা রয়েছে স্বীকার করেই তিনি বলেন, এসব ভাটা মালিকরা উচ্চ আদালতে রিট করে তাদের ভাটা পরিচালনা করছেন। যে কারণে উচ্চ আদালতের রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে দশের অধিক ভাটার রিট নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের প্রক্রিয়াধিন রয়েছে।
তবে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সর্ম্পকে তিনি বলেন, আমরা জেলা প্রশাসকের সাথে সমন্বয় করে দ্রুত জবাব পাঠাবো।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, জেলার বেশ কিছু ভাটায় কাঠ ও তুষকাঠ পোড়ানো হচ্ছে এমন অভিযোগ আমার কাছে এসেছে। আগামী ২/১দিনের মধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে এসব ইট ভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সাথে জেলার সকল অবৈধ ইটভাটা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।