বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২৩ উপলক্ষ্যে সাতক্ষীরা জেলার জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ সমস্যা মোকাবেলায় জনগণের প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের দাবিতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পানি সম্পদ মন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় পানি কমিটির নেতৃবৃন্দ। সোমবার (৫ জুন) দুপুরে দেড়টার দিকে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহম্মাদ হুমায়ুন কবির এর সম্মেলন কক্ষে তাঁর হাতে এই স্মারকলিপি তুলে দেয়া হয়।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতা ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সাতক্ষীরা অঞ্চল অতি ঝুঁকিপূর্ণ একটি এলাকা। জলাবদ্ধতা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা প্রভৃতি সমস্যার কারণে এ অঞ্চল ক্রমশঃ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছ্ েএবং বাস্তুভিটা ত্যাগ করে স্থানান্তÍরিত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যশোর-খুলনা-সাতক্ষীরা-বাগেরহাট জেলা দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অন্তর্গত। এর দক্ষিণে রয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্য খ্যাত সুন্দরবন। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সৃষ্ট সমস্যা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি প্রভৃতি সমস্যার সাথে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় সমস্যা তথা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা এবং সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষার সংকট। ফলে সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলা অতি ঝুঁকিপূর্ণ জেলা তালিকার মধ্যে গণ্য হয়েছে।
আইপিসিসি এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০৩০ সালে উপকূল এলাকায় ৩০ সেন্টিমিটার সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে উপকূল এলাকার নদ-নদীগুলোতে ইতিমধ্যে ৩০ সেন্টিমিটার বা ১ ফুটের অধিক জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে যার কারণে বিশেষ করে অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারের চাপে উপকূলের বাঁধ উপচিয়ে বা ভেঙ্গে পোল্ডার অভ্যন্তরে পানি ঢুকে জনপদ প্লাবিত করছে।
সাতক্ষীরা জেলার উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত সমস্যাগুলো হলো জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, উচ্চ জোয়ার প্রভৃতি সমস্যা। এসব সমস্যার কারণে অনেক এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এবং সেইসব এলাকা থেকে মানুষজন স্থানান্তরিত হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। দিন দিন এ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাতক্ষীরা জেলার উত্তর ভাগে জলাবদ্ধতার প্রকোপ বেশী আর দক্ষিণ ভাগে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত আঘাত বিশেষ করে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং উচ্চ জোয়ারের চাপ বেশী। এর সাথে রয়েছে লবণাক্ততার তীব্রতা এবং নতুন করে যুক্ত হয়েছে বর্ষাকালে খরা সমস্যা।
সাতক্ষীরা জেলার প্রধান ৩টি নদী ইছামতি, বেতনা ও কপোতাক্ষ নদ উপরে মাথাভাঙ্গা নদীর মাধ্যমে পদ্মা প্রবাহের সাথে যুক্ত। বেতনা ও কপোতাক্ষ নদ দেড়শো বৎসর পূর্বে মাথাভাঙ্গা নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে সাতক্ষীরা অঞ্চলে এখন আর পদ্মা প্রবাহের কোন পানি আসে না। ইছামতি নদীতে বর্ষাকালে সামান্য কিছু পানি পাওয়া যায়। মিষ্টি পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় এলাকায় লবণাক্ততার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে নদীতে পলি জমার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। বলা বাহুল্য সুন্দরবনের বিপর্যয়ের মূল কারণ উজান প্রবাহের বিচ্ছিন্নতা।
স্মারকলিপিতে আরো বলা হয়, ১৯৬০ দশকে পোল্ডার ব্যবস্থার মাধ্যমে এলাকার মূল নদীগুলোকে বিল খাল থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। পূর্বে জোয়ারে আগত পলি বিলে অবক্ষেপিত হতো এখন তা অবক্ষেপিত হয় নদী বক্ষে। এভাবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে এবং জীবিত প্রাণদায়িনী নদীগুলো একের পর এক মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। প্রায় ৬০ বৎসর পূর্বে নির্মিত উপকূলীয় বাঁধ সংস্কারের অভাবে নীচু, ভঙ্গুর ও দূর্বল হয়ে পড়েছে। উচ্চ জোয়ার এবং জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলায় বাঁধগুলোর সক্ষমতা যথেষ্ট নয়। সিডর, আইলা, রেশমি, বিজলী, নার্গিস, মহাসেন প্রভৃতি প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাসের তান্ডবে এলাকায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, এ এলাকায় আদৌ বসবাস করা যাবে কিনা? এসব প্লাবন প্রতিরোধে সুন্দরবন ও উপকূলীয় বাঁধগুলো মোটেই সক্ষম নয়। অমাবশ্যা ও পূর্নিমার জোয়ার এবং বর্ষাকালে উপরের পানির চাপেও বাঁধগুলো ভেঙ্গে বা উপচিয়ে এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পোল্ডার পূর্বে যেসব এলাকা জোয়ার দ্বারা প্লাবিত হতো না এমন অনেক জায়গায় এখন জোয়ার দ্বারা প্লাবিত হয়। এতে এটি প্রমাণিত হয় যে, সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাতক্ষীরা অঞ্চল চিংড়ী চাষের জন্য বিখ্যাত। এলাকার প্রায় ৪০ ভাগ জমিতে চিংড়ী চাষ করা হয়। চিংড়ী ঘেরে পানি তোলার জন্য বাঁধে পাইপগেট বসানো হয়। বাঁধের উপর স্থাপিত পাইপগেটের উপর দিয়ে জলোচ্ছ্বাস, উচ্চ জোয়ার বা উপরের বর্ষার পানি সহজেই জনপদে ঢুকে পড়ে। ঘেরে নদীর পানি উঠানোর দরুণ খালগুলো পলি দ্বারা ভরাট হয়। ঘেরের নোনা পানির প্রভাবে মাটি, গাছপালা, পুকুর, ঘরবাড়ি সব লবণাক্ত হয়ে পড়ায় পরিবেশের ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে। গবাদি পশুর বিচরণ ভূমি হ্রাস পায় এবং দেখা দেয় খাদ্য সংকট। ভূ-গর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততার তীব্রতা বৃদ্ধি করে সুপেয় পানির সংকট আরো তীব্র করে তোলে। ঘের এলাকার ভূ-প্রকৃতি শুষ্ক, রুক্ষ এবং বিবর্ণ হয়ে পড়ে।
পানি কমিটির নেতৃবৃন্দ বলেন, সাতক্ষীরা জেলার দক্ষিণ ভাগে সুপেয় পানির বড় ধরণের সংকট রয়েছে। উজান বিচ্ছিন্নতা, চিংড়ী চাষ এবং খরার কারণে এ সমস্যার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকাংশ মিষ্টি পানির আঁধার যথা খাল-বিল-জলাশয়, দিঘী-পুকুর মৎস্য চাষে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে নতুন সমস্যা বর্ষাকালে খরা দেখা দিচ্ছে । এ এলাকার সাধারণ তাপমাত্রা ছিল সর্বোচ্চ ৩৯ ডিগ্রী তা এখন ৪২ ডিগ্রীতে এবং শীতকালে সর্ব নি¤œ ১১ ডিগ্রী এখন তা ৭ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। অতিরিক্ত তাপদাহ, বর্ষাকালে বর্ষা না হওয়া, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পাওয়া প্রভৃতি কারণে এলাকার ষড়ঋতু চক্রে বিভিন্ন ধরণের বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
সমুদ্র সৃষ্ট ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও উচ্চ জোয়ার মোকাবেলায় সুন্দরবন প্রতিরক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিশাল খাদ্য ভান্ডার এবং প্রজনন ও বিচরণের অভয়ারণ্য হলো সুন্দরবন। জনপদের মানুষের জীবিকা ও ইকোলজি সুরক্ষায় সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পলি ভরাট ও তীব্র লবণাক্ততার কারণে সুন্দরবনের সে সক্ষমতা এখন আর নাই। পলি জমে সুন্দরবনের নদী খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে, শ্বাসমূল আচ্ছ্বাদিত হয়ে শ্বসনকাজ ব্যাহত হচ্ছে এবং গাছপালা এবং বিভিন্ন প্রাণীর জীবন যাপনে লবণাক্ততার বিরুপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে।
তারা বলেন, এ এলাকার নদ-নদী না বাঁচলে এবং উপকূলীয় বাঁধগুলো সুরক্ষা করা না গেলে এলাকায় বসবাস করা সম্ভব হবে না। নদী বাঁচলে এলাকার জলাবদ্ধতা ও সকল ধরণের পরিবেশ সমস্যা মোকাবেলা সহজ হবে। জনগণের এসব দাবীসমূহ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেন নেতৃবৃন্দ।
স্মারকলিপিতে জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ সমস্যা মোকাবেলায় টিআরএম বাস্তবায়ন, অবাধ নদী সংযোগ, উজান সংযোগ, উপকূলীয় বাঁধ সুরক্ষা, সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও চিড়ী চাষ নিয়ন্ত্রণসহ জনগণের বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনার কথা উল্লেখ করা হয়।
স্মারকলিপি প্রদানকালে উপস্থিত ছিলেন, কেন্দ্রীয় পানি কমিটির সভাপতি এবিএম শফিকুল ইসলাম, তালা উপজেলা পানি কমিটির সভাপতি শফিকুর রহমান, সাংবাদিক কল্যাণ ব্যানার্জী, পানি কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দীন জোয়াদ্দার, তালা উপজেলা পানি কমিটির সাধারণ সম্পাদক মীর জিল্লুর রহমান, সাতক্ষীরা পানি কমিটির সদস্য মঞ্জুয়ারা মহুয়া, কেন্দ্রীয় পানি কমিটির সদস্য সরদার ইমান আলী, হাশেম আলী ফকির, গাজী শহিদুল্লাহ, মোসলেমা খাতুন, হাফিজুর রহমান, আনারুল ইসলাম প্রমুখ।
খুলনা গেজেট/এনএম