জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির সংকট ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে। লবনাক্ততা বৃদ্ধির ফলে এই অঞ্চলের পুকুর এবং নলকূপের মতো মিঠা পানির উৎস দিন দিন কমে আসছে। অপর দিকে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি তারা অবলম্বন করে তা স্বল্প পরিসরে, দীর্ঘ মেয়াদী নয়। দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে বেড়েছে ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়,জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক, ইউরিন্যাল ইনফেকশান, চর্মরোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য, যৌনাঙ্গে চুলকানি, ঘা এবং জালাপোড়ার মতো রোগ। নারীদের মধ্যে এই সকল রোগের প্রাদূর্ভাব বেশি দেখা দিচ্ছে যা পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদী রোগ যেমন টিউমার এবং জরায়ু ক্যান্সারে রুপান্তরিত হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার দুইটি ইউনিয়ন-ভাড়াশিমলা এবং মথুরেশপুরে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার। বৃষ্টি কম হওয়ার কারনে কালিগঞ্জ ওয়াপদা পুকুরে পানির একেবারে নিচে নেমে আসার কারণে বিভিন্ন পুকুরের সাথে যে পিএসএ ফিল্টার রয়েছে তা এখন একেবার বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। ফলে এই অঞ্চলের মানুষ সরাসরি অথবা ফিটকিরি দিয়ে পানি পান করছে। সরেজমিনে দেখা যায় এসকল পুকুরের পানিতে ব্যাঙাচি জন্ম নিয়েছে। কালিগঞ্জ উপজেলার দশটির বেশি গ্রামের ছয় হাজারের অধিক পরিবারের মানুষ এই পানির উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে থাকে। দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য কালিগঞ্জ ওয়াপদার বিভিন্ন পুকুর থেকে ব্যাঙাচি যুক্ত পানি সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন নারীরা।
এই ব্যাপারে নারায়নপুর গ্রামের রহিমা খাতুন বলেন, পানির আর কোন উৎস না থাকায় আমরা এই পানি সংগ্রহ করে ব্যবহার করছি। এছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। বাজারে যে পানি কিনতে পাওয়া যায় তার দাম পূর্বের তুলনায় দিগুণ। করোনা পরিস্থিতির কারণে আমাদের আয়ের উৎস কমে গেছে, তাই পানি কিনে খাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না।
রহিমা খাতুন আরোও জানান, নোংরা পানিতে গোসল করার কারনে নারীদের সাদা স্রাব বেশি হচ্ছে (লিউকোরিয়া)। ডাক্তাররা পরিষ্কার পানিতে গোসল করার পরামর্শ দেন, কিন্তু যেখানে খাবার পানিই পাওয়া যায়না সেখানে গোসলের জন্য পরিষ্কার পানি পাওয়া দুষ্কর।
বিশুদ্ধ পানির সংকট নিয়ে একই গ্রামের সফুরা জানান, খাবার পানির যেমন সমস্যা রয়েছে তেমনই তাদের রান্না এবং গোসলের জন্য নোনা পানি ব্যবহার করতে হয়, ফলে তাদের অধিকাংশের ডায়রিয়া আর আমাশয় এর মতো রোগ লেগেই আছে।
মথুরেশপুর ইউনিয়নের হাড়দাহেও দেখা গেছে একই চিত্র। কালাবোনিয়ায় পুকুরের পানিও তলানিতে ঠেকেছে, অগত্য মানুষ ঐ পানি সংগ্রহ করে খাচ্ছেন। এই পুকুরের পানি সাত গ্রামের তিন হাজার পরিবার সংগ্রহ করে খাচ্ছেন।
ভূক্তভুগী হাড়দাহের হালিমা বেগম বলেন, পানি মেপে মেপে খাই। এই খরমে পানি মেপে খেলে কি শরীর থাকে? আমাদের বাড়ির সবার ইউরিন্যাল ইনফেকশান। আমাদের এলাকায় শতকরা নিরানব্বই জনের এই সমস্যা আছে বলে আমি মনে করি।
পানি বিক্রি করে সংসার চালনো রূপবান বলেন, আগে পিএসএ ফিল্টারের পানি নিয়ে বিক্রি করতাম, কিন্তু এখন পানি নেই। এখন সরাসরি নলকূপের পানি তুলে বিক্রি করছি। এই পানিও অতোটা ভালো না, কিন্তু উপায় নেই। এছাড়া আর পানি কই? এখন বাধ্য হয়ে এই পানি মানুষকে দিতে হচ্ছে।
এই ব্যাপারে মথুরেশপুরের এক গ্রাম্য চিকিৎসক বলেন, ইউরিন্যাল ইনফেকশান এবং লিকোরিয়া রোগী এখন একটু বেশি পাচ্ছি। পানি কম খাওয়ার কারনে ইউরিন্যাল ইনফেকশান এবং নোংরা পানিতে গোসলের জন্য লিকোরিয়ার মতো রোগের প্রকোপ বেড়েছে। পরবর্তীতে এই সকল অসুখ থেকে জরায়ুতে ইনফেকশান এবং ক্যান্সারও হতে পারে।
অপর দিকে কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর কর্তব্যরত এমবিবিএস ডাক্তার মাহাতাব হোসেন বলেন, করোনার মধ্যে সাধারণত জ্বর ছাড়া রোগী কম ভর্তি হচ্ছে বা ডাক্তার দেখাতে আসছে। তবে ইউরিন্যাল ইনফেকশান, যৌনাঙ্গে চুলকানি এবং সাদা স্রাব (লিউকোরিয়া) এর মতো অসুখ নিয়েও অনেকে আসছেন।
এই বিষয়ে কালিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদী বলেন, পানির সমস্যার বিষয়টি আমাদের অজানা নয়। ইতোপূর্বে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাথে আমরা বসেছি। বিষয়টি আমরা খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছি, কিন্তু করোনার জন্য এই সমস্যা সমধানে তেমন অগ্রগতি হয়নি। আগে জেলা পরিষদের অধীন বিভিন্ন পুকুরে মাছ চাষ করা হতো, স্থানীয় জনগনের পানির চাহিদা পূরণের জন্য এবছর সব পুকুর ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে বলেও জনানা তিনি।
একশনএইড এর কমিউনিকেশন অফিসার প্রেরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
খুলনা গেজেট/কেএম