গণতন্ত্রের নামে গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে ৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কখনো ইভিএম ক্রয়, কখনো ব্যালট পেপার ছাপাসহ নির্বাচন পরিচালনার সার্বিক কার্যক্রমে এই অর্থ ব্যয় করা হয়। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার কথা বলা হলেও ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন মূলত শেখ হাসিনার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছিল।
এর মধ্য দিয়ে একদিকে বিরোধী রাজনীতি নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে, অন্যদিকে শেখ হাসিনার শাসনকে ফ্যাসিবাদে পরিণত করার পথ প্রশস্ত করেছে। এসব নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে পরপর তিনটি নির্বাচন কমিশন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠানোর সুদূরপ্রসারী এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশই হচ্ছে নির্বাচন। যার মাধ্যমে জনগণ বিকল্প বেছে নিতে পারে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে সেই ক্ষমতার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাই নির্বাচন শুধু আইনি বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয় নয়; এর সঙ্গে ক্ষমতার বৈধতা, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সবকিছুই জড়িত। কিন্তু গত তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু একটি দল বা শক্তিকে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার টিকিট নবায়ন করা হয়। যার নেতিবাচক প্রভাব দেশের অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সবক্ষেত্রেই পড়ে। সর্বোপরি এসব নির্বাচনের কারণেই সম্প্রতি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রায় এক হাজার মানুষের জীবন উৎসর্গ করতে হয়। শুধু তাই নয়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন সরকারপ্রধান। সেজন্য ভবিষ্যতে এরকম পরিস্থিতি এড়াতে নির্বাচন কমিশনকে ব্যাপকভাবে সংস্কারের পরামর্শ বিশ্লেষকদের।
স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে আটবার সামরিক শাসনসহ দলীয় সরকার এবং চারবার নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। সর্বশেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে করার কারণে ১৫ বছর ধরেই বিতর্ক চলছে। এ তিনটি নির্বাচনের কোনোটিকে ‘একতরফা’, কোনোটিকে ‘রাতের ভোট’ এবং কোনোটিকে ‘ডামি’ নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যার মধ্য দিয়ে একটি দলকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার বৈধতা দেওয়া হয়েছে। আর সুদূরপ্রসারী এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শুধু এই তিনটি নির্বাচনেই অন্তত ৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৬৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনটি ছিল মূলত আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের মধ্যে আসন ভাগাভাগির। ওই নির্বাচনে ভোটের আগেই ১৫৩ প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
২০১৮ সালের ভোটে প্রথমে ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও পরে তা বাড়িয়ে দ্বিগুণের বেশি করা হয়। নানা প্রতিশ্রুতির পর শেখ হাসিনার অধীনে এ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী দলগুলো অংশ নিলেও সারা দেশে ভোটের আগের রাতেই বাক্সে ব্যালট ভরে রাখা হয়। এ কাজে ব্যবহার করা হয় স্থানীয় প্রশাসন ও দলীয় নেতাকর্মীদের। এ কারণে এটি ‘রাতের ভোটের নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ওই নির্বাচন আয়োজনে শেষ পর্যন্ত ব্যয় করা হয় প্রায় ১ হাজার ৪৪৫ কোটি।
সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রায় ২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এবারও বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্যে শেখ হাসিনার অধীনে এ নির্বাচন শুধু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট ও দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। সেজন্য এ নির্বাচনকে ‘আমি আর ডামি’ নির্বাচনও বলা হয়ে থাকে। ফলে সর্বশেষ এ তিনটি নির্বাচন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে অন্যতম কালো অধ্যায় হিসেবে রচিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নামে এসব নির্বাচন আয়োজন করে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। তবে সর্বশেষ নির্বাচনের মাত্র ছয় মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচন মানে বিকল্প বেছে নেওয়া। কিন্তু গত তিনটি নির্বাচনে জনগণ সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এসব নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু একটি দল বা শক্তির ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার টিকিট নবায়ন করা হয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতিসহ দেশের সব ক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) নামে জনগণের টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এতে নির্বাচন কমিশন ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত কারোরই শেষ রক্ষা হয়নি। সেজন্য অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্বাচনে যাতে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়, ভবিষ্যতে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।’
এদিকে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিনতে রাষ্ট্রের ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা গচ্চা দেওয়া হয়েছে। এক-এগারো সরকারের সময়কার ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন দেশের ভোট ব্যবস্থায় ইভিএমের ব্যবহার শুরু করে। সে সময় তারা বুয়েট থেকে ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে যন্ত্র তৈরি করে নেয়। ওই কমিশনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনও ভোট যন্ত্রটি ব্যবহার করে।
তবে ২০১৫ সালে রাজশাহী সিটি নির্বাচনে একটি মেশিন অচল হয়ে পড়ায় তা আর ব্যবহার উপযোগী করতে পারেনি রকিব কমিশন। পরবর্তী সময়ে তারা বুয়েটের তৈরি স্বল্প মূল্যের ওই মেশিনগুলো পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত দিয়ে উন্নতমানের ইভিএম তৈরির পরিকল্পনা রেখে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে কেএম নূরুল হুদার কমিশন এসে বুয়েটের তৈরি ইভিএমের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি দামে মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নেয়।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) কাছ থেকে মেশিনপ্রতি ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকায় দেড় লাখের মতো ইভিএম ক্রয় করে। কিন্তু পাঁচ বছর পার না হতেই ৯০ ভাগ ইভিএম অকেজো হয়ে পড়ে।
ইভিএমকেন্দ্রিক লুটপাট থেকে পিছিয়ে থাকতে চায়নি সদ্য বিদায়ী কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনও। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে শুরুতে দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট করার পরিকল্পনা নেয় তারা। সেজন্য নির্বাচন সামনে রেখে অকেজো মেশিন মেরামত, সংরক্ষণ প্রভৃতির জন্য এবার তারা ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব দেয় সরকারের কাছে। সেজন্য নানাভাবে দেনদরবারও চলে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল থেকে। তবে ওই সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে একপর্যায়ে নানা সমালোচনার মুখে সরকার সেটি নাকচ করে দিতে বাধ্য হয়।
তবে বড় প্রকল্প বাতিল হয়ে গেলেও বসে থাকেনি কমিশন। ফলে হাতে থাকা পুরোনো ইভিএমগুলো সচল রাখতে আবারও ১ হাজার ২৫৯ কোটি ৯০ লাখ টাকার চাহিদাপত্র দেয় আউয়াল কমিশন। ইভিএম মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা বরাদ্দ চেয়ে চিঠি চালাচালি এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পরও ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে চরম হতাশ হয় সংস্থাটি। আর ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে কোনো আসনেই ইভিএমে ভোট গ্রহণ না করে সব আসনেই ব্যালটে ভোট নেওয়া হয়। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা ইভিএমগুলো বর্তমানে ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সরকারের চাওয়া পূরণ করতে নিজেদের হাতে থাকা ভোট বাতিলের মতো ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব দিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হয় সর্বশেষ এ কমিশন। পরে তা জাতীয় সংসদে আইন আকারে পাস করে নেয় শেখ হাসিনা সরকার।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে খরচ হয়েছিল ৮১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এরপর দ্বিতীয় নির্বাচনে ২ কোটি ৫২ লাখ, তৃতীয় নির্বাচনে ৫ কোটি ১৬ লাখ, চতুর্থ নির্বাচনে ৫ কোটি ১৫ লাখ, পঞ্চম নির্বাচনে ২৪ কোটি ৩৭ লাখ, ষষ্ঠ নির্বাচনে ৩৭ কোটি, সপ্তম নির্বাচনে ১১ কোটি ৪৭ লাখ, অষ্টম নির্বাচনে ৭২ কোটি ৭১ লাখ এবং নবম জাতীয় নির্বাচনে ১৬৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হয়।
সূত্র : কালবেলা