খুলনা, বাংলাদেশ | ১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  আইপিএল নিলামে অবিক্রিত মোস্তাফিজুর রহমান, ভিত্তিমূল্য ছিলো ২ কোটি রুপি
  ইসকন নেতা চিন্ময় দাসকে বিমান বন্দরে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি
  কক্সবাজারের টেকনাফ সমুদ্র সৈকতে গোসলে নেমে নিখোঁজ দুই শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার
  সাবেক আইজিপি মামুনের ফের ৩ দিনের রিমান্ড

সাগরে সৃষ্টি হতে চলেছে ঘূর্ণিঝড়, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ভাঙার আতঙ্কে উপকূলবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

মোবাইলে ইন্টারনেট পরিসেবার কারণে এখন আবহাওয়ার আগাম সব খবর পয়ে যায় উপকূলের মানুষ। চলতি অক্টোরবর মাসের শেষ সপ্তাহের দিকে গভীর বঙ্গোপসাগরে সিত্রাং নামের একটি ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হবে সেখবরও ইতিমধ্যে পেয়ে গেছে তারা। যেটি আগাত আনতে পারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও বাংলাদেশের সুন্দরবন উপকূলে। ফলে আগের দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সাতক্ষীরার উপকূলবাসী। বিশেষ করে দুর্বল বেড়িবাঁধ নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দু’টি বিভাগের আওতাধীন প্রায় ৭৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে, যা ষাটের দশকে নির্মিত। ষাটের দশকে নির্মাণ করা এখানকার এই বেড়িবাঁধ গুলো আর পুননির্মাণ করা হয়নি। এসব বাঁধ এখন আর সামাল দিতে পারছে না ঝড়-জলোচ্ছ¡াসের ধাক্কা। জিও ব্যাগের বালুর বস্তা আর রিং বাঁধ দিয়ে কোনো রকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত এসব বেড়িবাঁধ। জেলার উপকূলের এসব বাঁধের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ৩৫টি পয়েন্টর প্রায় ২০০ কিলোমিটার। এছাড়া বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারও। ফলে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের অঘাতে ঝুঁকিপূর্ণ এসব বেড়িবাঁধ ভাঙন আতংকে রয়েছে উপকূলের মানুষ।

সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। সে সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা। এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৩ মে ফণী, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল আঘাত হানে। সবশেষ ২০২০ সালের ২০ মে বিকেলে সুন্দরবনের পাশ দিয়ে সাতক্ষীরা উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এ সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন। যার ক্ষত শুকায়নি এখনো।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের শেষ জনপদ সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন। সুন্দরবনের কুল ঘেঁষা এই দীপ ইউনিয়নের শেষ প্রান্তে খোলপেটুয়া নদীর তীরে বেড়িবাঁধে বসবাস করেন সেলিনা বেগম। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর নদীতে বিলীন হয়ে যায় আমাদের ভিটামাটি। স্থায়ী মেরামত না হওয়ায় এখনো সেখানে জোয়ার ভাটা চলছে। তখন থেকে আমরা বেড়িবাঁধের পাশে একটি ঘর তৈরি করে বসবাস করছি।

তিনি আরও বলেন, এখানেও শান্তিতে নেই। গেলো কয়েক বছরে ফণী, বুলবুল, আম্পানসহ একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আশ্রয়স্থলটি। শুনলাম আবার নতুন ঝড় আসবে এতে আবারও ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কায় আছি।

সেলিনার মতোই আতঙ্কে দিন পার করছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধের পাশে বসবাসরত হাজারো পরিবার। দুর্যোগ এলেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন এখানকার মানুষ। দুর্বল বেড়িবাঁধ উদ্বেগের প্রধান কারণ। দুর্যোগে নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লেই বারবার বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় লোকালয়। লবণ পানি ঢুকে বিপর্যস্ত হয় জীবনযাত্রা। নষ্ট হয়ে যায় খাবার পানির উৎসসহ, সরকারের সব উন্নয়ন কর্মকান্ড। তাই দুর্যোগে সবসময় বাঁধ ভেঙে প্লাবন আতঙ্কে দিন কাটান এখানকার মানুষ। এছাড়া উপকূলে বসবাসরত বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারও।

গাবুরার চিংড়ি চাষি শহিদুল আলম বলেন, গতবার আম্পানের সময় আমার প্রায় ২০বিঘা জমির মাছের ঘের নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। সেবার অনেক টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনো সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারিনি। আবার শুনছি নতুন করে ঝড় আসবে। এবার বাঁধ ভাঙলে একেবারে পথে বসতে হবে আমাদের ।

গাবুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা কবিরুল ইসলাম বলেন, ষাটের দশকে উপকূলীয় এলাকায় নির্মিত বেড়িবাঁধ ২০০৯ সালে আইলা ও সবশেষ ২০২০ সালে আম্পানের তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এখনো আমাদের ইউনিয়নে বেড়িবাঁধের আটটি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। জোয়ারের পানি বাড়লেই বাঁধ ভেঙে আবারো প্লাবিত হবে বিস্তীর্ণ এলাকা। এর আগে বার বার বাঁধ ভাঙলেও টিকে থাকার স্বার্থে মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে রিং-বাঁধ দিয়ে পানি বন্ধ করে। তবে এখনো স্থায়ী বাঁধ হয়নি। এখন ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ এর খবরে নতুন করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন এখানকার মানুষ।

এ বিষয়ে গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম বলেন, গাবুরা ইউনিয়নে বাসিন্দা প্রায় ৪৫ হাজার অথচ এখানে সাইক্লোন শেল্টার আছে মাত্র ১৫টি। এত মানুষকে এ কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া স্কুল, মাদরাসাসহ বিভিন্ন পাকা ভবনে অল্প কিছু মানুষকে আশ্র দেওয়া সম্ভব। এত মানুষকে এই অল্প কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। আরো সাইক্লোন শেল্টারের প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, ঝড়ের চেয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় ভয় বেড়িবাঁধ নিয়ে। আগে থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ কোনো রকমে টিকে আছে। নদীর পানি বাড়লেই বিভিন্ন অংশে ভাঙন তৈরি হতে পারে। সরকার নতুন করে এখানে টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিলেও কাজ শুরু হয়নি এখনো।

প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান হাজী আবু দাউদ ঢালী বলেন, ২০২০ সালে আম্পানের তান্ডবে বেড়িবাঁধ ভেঙে পুরো ইউনিয়ন পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। প্রায় ছয়মাস ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি হয়ে ছিল। মানুষ মারা গেলে কবর দেওয়ার মত মাটি ও জেগে ছিলনা অনেক স্থানে। বার বার বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়ে বাড়ি ঘর হারিয়ে নিস্ব হচ্ছে ইউনিয়নের অনেক মানুষ। ইউনিয়নের দুই পাশ দিয়ে কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়ানদী দ্বারা বেষ্টিত। এখানকার অধিকাংশ বেড়িবাঁধ খুবই ঝূকিপূর্ণ। এই অবস্থায় সিত্রাং ঘূর্ণিঝড় আগাত হানলে এসব ঝুকিপূর্ণ বাঁধ ভেঙে পুরো ইউনিয়ণ আবারো প্লাবিত হয়ে পড়বে।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ আক্তার হোসেন বলেন, আগের কয়েকটি দুর্যোগে অগ্রিম প্রস্তুতি থাকায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমানো গেছে। এবারো আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নয়েছি। তিনি আরও বলেন, শ্যামনগর উপজেলায় সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে ১০৩টি। এছাড়া স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ অন্য পাকা ভবনে আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে ১৮০টি। এসব কেন্দ্রে প্রায় এক লাখ মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব। তবে এ উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, তার বিভাগের অধীনে ৩৮০ কিলোমিটার উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে বাঁধ রয়েছে ৪২ কিলোমিটার। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দূর্গাবাটি, দাতনেখালী, দেবহাটার ভাতশালা ও হাড়দ্দহা ইত্যাদি। আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধগুলো সংস্কার করা হয়েছে। বাকি জায়গাগুলো পর্যায়ক্রমে সংস্কার হবে। তবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানেওয়াজ তালুকদার বলেন, তার বিভাগের অধীনে প্রায় ৪০০ কিলোমটিার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৪০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ এসব বাধেঁর মধ্যে সাতক্ষীরার মধ্যে রয়েছে মাত্র ১০ কিলোমিটার। বাকি ৩০ কিলোমিটার খুলনার কয়রার মধ্যে। সাতক্ষীরায় তার এলাকার মধ্যে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, আনুলিয়া, শ্রীউলা ও আশাশুনি সদরের কিছু অংশ এবং শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়নে বেশ কিছু বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। পাউবো’র পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামতের কাজ চলমান রয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক হুমায়ুন করিব বলেন, এরই মধ্যে উপকূলীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দুর্যোগ মোকাবিলায় অগ্রিম প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় জেলায় সাইক্লোন শেল্টারের সংখ্যা অনেক কম। আগামীতে নতুন করে আরও কিছু সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের চারপাশে নতুন করে টেকসই বাঁধ নির্মাণে এক হাজার কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে টেন্ডার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আশা করছি চলতি বছর নতুন বাঁধের কাজ শুরু হবে।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!