আমেরিকায় মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি, পিএইচডি গবেষক ছেলের ফেসবুক স্ট্যাটাসের জের ধরে খুলনায় তার মা’কে গ্রেপ্তারের অভিযোগ উঠেছে। খুলনার খালিশপুর থানা পুলিশ গত ২০ আগস্ট পিএইচডি গবেষক তানজিলুর রহমানের মা আনিছা সিদ্দিকাকে গ্রেপ্তার পরে। পরে আটক অন্য দুই যুবকের সঙ্গে আনিছার বিরুদ্ধেও সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা করেছে। গতকাল ২১ আগস্ট তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ।
ছেলের ফেসবুক স্ট্যাটাসে মা গ্রেপ্তার-সংবাদ নিয়ে দুই দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আলোচনা সমালোচনা চলছে।
বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে ম্যাটেরিয়াল সাইন্সের পিএইচডি গবেষণারত তানজিলুর রহমান ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন- ‘আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালির ভূমিকা আমার কাছে ইতিহাসের বিরল ঘটনা বলে মনে হয়। তাকে আমি কোনো ছকেই ফেলতে বা বুঝতে পারি না। তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় ব্যাপারটা আরও অদ্ভুত। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে প্রথমে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং পরে হাইকোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন সুখরঞ্জন বালির ভাই বিসা বালির হত্যাকাণ্ডে।
এই মামলার রায় সঠিক হয়নি বলে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সুখরঞ্জন বালি আদালতে সাক্ষী দিতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে অপহৃত হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ভারতের কারাগরে আটক ছিলেন। বিবেকের তাড়নায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জানাজায় উপস্থিত হয়ে আইন বিচার এবং পুলিশের কর্মকাণ্ড মিডিয়ার কাছে তুলে ধরেন।’ এই স্ট্যাটাস দেয়ার একদিন পরই তানজিলুর রহমানের মা আনিছা সিদ্দিকাকে খুলনার খালিশপুর থানার বয়রা হাজী ফয়েজ উদ্দীন সড়কের মামা বাড়ি থেকে ২০শে আগস্ট আটক করে পুলিশ।
ওইদিনের অপর একটি স্ট্যাটাসে তানজিলুর রহমান উল্লেখ করেন- ‘সাঈদী সাহেবের জানাজায় সুখরঞ্জন বালির উপস্থিতি নিয়ে আমার লেখাটা অনেক জায়গা থেকে শেয়ার হওয়ায় রোববার, ২০শে আগস্ট খুলনার বয়রা এলাকার হাজী ফয়েজউদ্দীন সড়কে আমার নানাবাড়িতে স্থানীয় যুবলীগ নেতারা পুলিশ নিয়ে হাজির হয়ে তাণ্ডব চালায় ও লুটপাট করে। দুইটা ল্যাপটপ ও নগদ টাকা নিয়ে যায়। আমার ছোট মামা সিদ্দিক শহীদকে বেদম মারধর করে।
আমার মা আনিছা সিদ্দিকা এগুলো সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ জানানোয় তাকে খালিশপুর থানায় ধরে নিয়ে গেছে। দুইজন ভাড়াটিয়া এগিয়ে আসায় তাদেরকেও সঙ্গে নিয়ে গেছে। জি হুজুর শুনে অভ্যস্ত পুলিশ প্রতিবাদের কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে আমার মা’কে সারারাত থানাহাজতে আটকে রেখে গোপন বৈঠকের অভিযোগে মামলা দিয়ে কোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছে।’
আবেগঘন এই স্ট্যাটাসে পিএইচডি গবেষক তানজিলুর রহমান বলেন, ‘আজ আমার মা গ্রেপ্তার হয়েছে, কাল আপনার মা’কে ধরে নিয়ে যেতেও পুলিশ দুইবার ভাববে না। আজকে আমার মা’কে খালিশপুর থানা থেকে যদি খুলনা কারাগারে যেতে হয়, এই লজ্জা বাংলাদেশে এখনো কোনো মানুষ যদি অবশিষ্ট থেকে থাকেন, তাদের সবার। আর যদি শুধু পা চাটা দালালেরাই অবশিষ্ট থাকে তাহলে আমার প্রিয় জন্মভূমির কাছে আপাতত কোনো আবেদন নেই।’
এদিকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুল গিয়াস জানান, গত ২০শে আগস্ট সকাল আনুমানিক ১২টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খালিশপুর থানা পুলিশের বিশেষ অভিযানে বড় বয়রাস্থ হাজী ফয়েজ উদ্দিন রোড-এর জনৈক ব্যক্তির বাড়ি থেকে অন্তর্ঘাতমূলক ষড়যন্ত্র করার জন্য সমবেত হয়। এ অভিযোগে মো. রকিবুল ইসলাম (২৪), মো. তামিম ইকবাল (১৯) এবং আনিছা সিদ্দিকা (৪৫)কে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি বলেন, গ্রেপ্তারকালে ঘটনাস্থল থেকে আসামিদের হেফাজত থেকে বিপুল পরিমাণ ধর্মীয় উগ্রপন্থি বিভিন্ন বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন, রেজিস্টার, লিফলেট এবং অন্তর্ঘাতমূলক ষড়যন্ত্র করার কাজে ব্যবহৃত ৩টি ল্যাপটপ, পাসপোর্ট এবং ৪টি মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন মালামাল জব্দ করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে খালিশপুর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে তানজিলুর রহমানের পিতা ও আনিছা সিদ্দিকার স্বামী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক আলমগীর শিকদার জানান, আমার ছেলেদের লেখালিখি নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ক্ষুব্ধ ছিল। ২০ আগস্ট সকালে হঠাৎ জানতে পারি আনিছার বাবার বাড়িতে কারা যেন হামলা ও ভাংচুর করছে। ওই বাড়িতে আনিছার গর্ভবতী ভাইঝি, ও আরেক ভাইয়ের দুটি শিশু কন্যা ছিলো। তার ভাবীও ছিলো অসুস্থ। এ খবর শুনে আনিছা দ্রুত আমাদের বাড়ি থেকে ওই বাড়ি যায়। ভাঙচুরের প্রতিবাদ ও পুলিশের সঙ্গে তর্ক করায় আনিছাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। সেখানে মেসের দুই ছাত্রকে আগে থেকেই আটক করে রাখা হয়েছে। পরে তাদের ৩ জনকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। গতকাল তাদেরজেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
তবে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া শাখার এডিসি এ জেড এম তৈমুর রহমান জানান, ওই বাড়ি থেকে জামায়াতে ইসলামীর সব পর্যায়ের জনশক্তির প্রতি আমিরে জামায়াতের আহ্বান নামের বই, জামায়াতে ইসলামী খুলনা মহানগরের ৭০ পিস প্যাড, জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ বই জব্দ করা হয়েছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন গণমাধ্যম কর্মীদের বলেছেন, ‘আমরা গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছিলাম, খুলনার জামায়াতে ইসলামীর একজন নায়েবে আমিরের বাড়িতে নাশকতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি করতে একটি ষড়যন্ত্র চলছে। অনেকে জড়ো হয়েছে এমন তথ্যে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে একজন নারী ও দু’জন পুরুষ। পরে আমরা জানতে পেরেছি ওই নারীর ছেলে প্রবাসী, সে ফেসবুকে সাঈদীকে নিয়ে স্ট্যাটাস করেছে। তথ্য পেয়ে আমরা অভিযান চালাই। সেখানে আমরা ডিজিটাল ডিভাইস, বই পেয়েছি, মোবাইল পেয়েছি। এর আলোকে মামলা নেয়া হয়েছে। এটা কোনোভাবেই কাউকে উদ্দেশ্য করে গ্রেপ্তার করা হয়নি।’
আনিছা সিদ্দিকার ভাই ও ওই বাড়ির মালিক শহীদ সিদ্দিক অভিযোগ করেন, পুলিশের সঙ্গে আসা যুবলীগ নেতা ইয়াসমিন আরাফাত ও তার লোকজন বাড়িতে হামলা চালায়, ভাঙচুর করে। তারা অনেক মূল্যবান জিনিস নিয়ে গেছে। বাড়ির মহিলাদের দুই দিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। এখন আমাদের পুরো পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
খুলনা মহানগর যুবলীগের সদস্য ইয়াসমিন আরাফাত হামলা ও ভাঙচুর সম্পর্কে বলেন, পুলিশের অভিযানের সময় আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম। বাড়ির মালিককে রুমের তালা খুলতে বললে তারা বিলম্ব করে। এ সময় পুলিশ তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। আমি এলাকার বাসিন্দা হিসেবে উপস্থিত ছিলাম।
খুলনা গেজেট/এইচ