সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সাংবাদিকতার সংকট সমাধানের সারথি। তার মৃত্যুতে সাংবাদিক সমাজ একজন অভিভাবককে হারিয়েছে। তিনি ছিলেন বিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নের অবিভক্ত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের জন্য তার আদর্শ অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়।
মঙ্গলবার সম্পাদক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের স্মরণসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে যৌথভাবে এই স্মরণসভার আয়োজন করে সম্পাদক পরিষদ ও নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)। এতে সভাপতিত্ব করেন নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ। স্মরণসভার শুরুতে মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
সম্পাদক পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও বণিকবার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় স্মরণসভায় নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, রিয়াজ ভাইকে আমরা একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে পেয়েছি। তার জীবনের শেষ সভাটি ছিল নোয়াবের। নিজে সততা ও ইন্ট্রিগ্রিটি বজায় রেখেছেন বলেই সন্তানদেরও ইন্টিগ্রিটি, অনেস্টি ও হার্ড ওয়ার্ক করার পরামর্শ দিয়ে যেতে পেরেছেন। যেকোনো সংকট সমাধানে তিনি সঠিক সাজেশন দিতেন। তার আদর্শ চিরকাল বেঁচে থাকবে।
নোয়াবের সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ খান বাদল বলেন, তার মতো সজ্জন মানুষ আমার বাহাত্তর বছরের জীবনেও দেখিনি। তিনি ছিলেন সাংবাদিকতার অকৃত্রিম বন্ধু।
দ্য ডেইলি অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় রিয়াজ ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করেছি। তিনি ছিলেন ইকোনোমিক রিপোর্টার। আমি ছিলাম ডিপ্লোমেটিক ও পলিটিক্যাল রিপোর্টার। আজ অর্থনৈতিক সংবাদ খবরের কাগজগুলোতে গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়। আমাদের সময়ে এমন ছিল না। ইংরেজি খবরের কাগজে অর্থনীতির সংবাদকে চমৎকারভাবে তুলে ধরতেন রিয়াজ ভাই। ছাত্রজীবনে আমরা দু্’জন একই ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ করেছি। পরবর্তীতে মতাদর্শের ভিন্নতা থাকলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কে আমাদের মধ্যে কখনো বৈরিতা আসেনি।
তিনি আরও বলেন, রিয়াজ ভাই ছিলেন অবিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে পূর্বসূরিরা সাংবাদিক ইউনিয়নের যে একতাবদ্ধ পতাকা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন আমরা তা ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারিনি। রিয়াজ ভাই সাংবাদিক ছিলেন, সাংবাদিক হিসেবেই মৃত্যুবরণ করেছেন।
যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, আজীবন পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করেছেন রিয়াজ ভাই। আজকের সাংবাদিকতা নানা মতে, নানা ভাগে বিভক্ত। রিয়াজ ভাই ছিলেন বিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নের অবিভক্ত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, পাকিস্তান আমল থেকে রিয়াজ ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। তিনি সাংবাদিকতার সবকিছুকে স্পর্শ করেছেন। সংবাদপত্রে লিখেছেন, সম্পাদনা করেছেন, আবার সাংবাদিকতা পেশার উন্নয়নেও নেতৃত্ব দিয়েছেন, লড়াই করেছেন। সাংবাদিকতার পেশার মূল্যবোধকে ধারণ করেছেন। পেশাগত সততা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধারণ করেছেন।
সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, তিনি আমাদের অভিভাবক ছিলেন। তিনি ছিলেন সাংবাদিকতার সংকট সমাধানের সারথি। বর্তমান যুগে সংকট বাড়ানোর অনেক নেতা পাওয়া যায়। সমাধানের নেতা নাই। রিয়াজ ভাই সমাধানের নেতা ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, প্রিন্টার্স লাইনে নাম ছাপা হলেই সম্পাদক হওয়া যায় না। যোগ্যতা অর্জন করে সম্পাদক হতে হয়। রিয়াজ ভাই তাই ছিলেন।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, রিয়াজ ভাই আপাদমস্তক সাংবাদিক ছিলেন। সাংবাদিকদের বন্ধু ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে সকলের সম্মানের পাত্র ছিলেন। সাংবাদিকতা পেশা আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে অনেক নেতার অবদান আছে। তিনি তাদের অন্যতম।
প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, রিয়াজ ভাই ছিলেন সাংবাদিক সমাজের অভিভাবক। যেকোনো সমস্যা সংকটে আমরা তাকে দায়িত্ব দিতাম। তিনি সুন্দরভাবে তা সমাধান করতেন। আমাদের সকলের সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তাকে হারিয়ে আমরা অভিভাবক শূন্যতায় পতিত হয়েছি।
তিনি আরও বলেন, রিয়াজ ভাইয়ের লেখাগুলোকে একসঙ্গে গ্রন্থিত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
স্মরণসভায় রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের ছেলে মাশরুর রিয়াজ প্রয়াত পিতাকে স্মরণ করে বলেন, আমার বাবার দুইটা পরিবার। একটা ছিলাম আমরা। আরেকটা হচ্ছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। অনেক বেশি সময় তিনি এই পরিবারকে দিয়েছেন। বাবা খুব সরল মানুষ ছিলেন, সহজভাবে চিন্তা করতেন। সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন চাইতেন। আমাদের দুই ভাই-বোনকে তিনি সবসময় বলতেন, ইন্টিগ্রিটি, অনেস্ট ও হার্ড ওয়ার্ক করতে।
এছাড়াও স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম চৌধুরী।
এদিকে জাতীয় প্রেস ক্লাব নেতারা জানিয়েছে, জাতীয় প্রেস ক্লাবের আয়োজনে আগামী ৩ জানুয়ারি সকালে প্রেস ক্লাবে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের স্মরণসভার আয়োজন করা হবে।
উল্লেখ্য, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ শনিবার রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ভুগছিলেন।
১৯৬৮ সালে পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় যোগদানের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। ইংরেজি সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এই খ্যাতিমান সাংবাদিক প্রায় ৫০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রধান সম্পাদক, দি নিউজ টুডে সম্পাদক ও প্রকাশক, ডেইলি টেলিগ্রাফ সম্পাদক, ডেইলি স্টারের উপ-সম্পাদক ছিলেন। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার তথ্য উপদেষ্টা ছিলেন কিছু দিন। ছাত্রজীবনে তিনি প্রথমে ছাত্রলীগ ও পরে বাংলা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা ছিলেন।
তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, বিএফইউজের সভাপতি, মহাসচিব, সার্কভুক্ত দেশগুলোর সাংবাদিকদের ফেডারেশন সমন্বয়ে গড়া দক্ষিণ এশিয়া সাংবাদিক সমন্বয় পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সাউথ এশিয়ান ফ্রি মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন।
রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বরে রিয়াজ উদ্দিনের প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার নারান্দী চীন মৈত্রী কেন্দ্রের সামনে শরাফত আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে বাদ জোহর দ্বিতীয় এবং রাজধানীর বারিধারা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তৃতীয় জানাজা শেষে বনানীতে মায়ের কবরে রোববার বিকেলে তাকে সমাহিত করা হয়।
খুলনা গেজেট/এনএম