খুলনা পৌরসভার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান, খুলনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, প্রথিতযশা কর আইনজীবী, অবিভক্ত খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনিরুল হুদার জানাযা ও দাফন আজ শনিবার অনুষ্ঠিত হবে। শুক্রবার সকালে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানান, আজ শনিবার নিহতের মরদেহ খুলনায় আনা হবে। বাদ জোহর খুলনা আলিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে মরহুমের দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হবে। পরে টুটপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হবে।
এর আগে সাংবাদিক মনিরুল হুদার মরদেহ দুপুর ১২ টায় খুলনা প্রেসক্লাব চত্বরে আনা হবে। সেখানে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ তাকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।
মনিরুল হুদা খুলনার সকল স্তরের মানুষের কাছে শ্রদ্ধাভাজন ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন, ছিলেন আস্থার প্রতীক। খুলনার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় জীবন্ত কিংবদন্তী। ৭০ বছর সংবাদকর্মী হিসেবে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে উদাহরণ একমাত্র তিনি। দীর্ঘ সময়ে খুলনার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিল্প-কলকারখানা স্থাপন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পীর খানজাহান আলী (র.) সেতু, মেডিকেল কলেজ, বিমান বন্দর, শহর রক্ষা প্রকল্প, মংলা বন্দর আধুনিকায়ন, সর্বোপরি সুন্দরবনকে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি ধীমান সাংবাদিকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর নানামূখী প্রতিভা দৃশ্যমান। তিনি ভাষা সৈনিক, সাবেক ছাত্রনেতা, সাংবাদিক নেতা, আয়কর আইনজীবী ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।
বৃটিশ শাসনামলে মনিরুল হুদা বাগেরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। দিনটি ১৯৩৭ সালের ২৭ নভেম্বর। মরহুম সামছুল হুদা তাঁর পিতা। তিনি বাগেরহাটে মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। মরহুমা আমেনা খাতুন তাঁর মা। তাঁর মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্বটি কেটেছে বাগেরহাটে। সেখানেই তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। একই বছর ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সত্যযুগ পত্রিকায় বাগেরহাট থেকে ডাকযোগে সংবাদ পাঠাতে শুরু করেন। নিছক কৌতুহল বশত: খবর লিখে পাঠানো, পরবর্তীতে তা ছাপার অক্ষরে দেখা এবং তা-ই সারাজীবন নেশার মতোই তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে।
শুরুর পর্বে স্বাভাবিকভাবে তিনি ছিলেন খন্ডকালীন সংবাদদাতা। পেশাজীবী নন। তবে ওটাই তাঁর সাংবাদিকতার শুরু। পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ১৯৫৩ সালে তার সম্পাদনায় বাগেরহাট থেকে মাসিক বিদ্যুৎ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। এখানে বলে রাখা ভালো, ১৯৫৩ সালে কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ঢাকা হতে একুশে সংকলন প্রকাশিত হয়। আর সারা পূর্ব-পাকিস্তানের জেলা-মহকুমা পর্যায়ে অসংখ্য সংকলন প্রকাশিত হতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরেও অনেকদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে এরকম অগণিত পত্রিকা, স্মরণিকা প্রকাশিত হতো। মনিরুল হুদা সম্পাদিত বিদ্যুৎ নামের পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হতো। পর পর আট সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তারপর মনিরুল হুদা উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যান রাজশাহী কলেজে। ফলে বাগেরহাট হতে বিদ্যুৎ-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগেই ১৯৫০ সালের ১১ ডিসেম্বরের একটি ঘটনা তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা ঘটনা। ওইদিন চালনা বন্দর কর্তৃপক্ষ-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। পশুর নদীর জয়মনির গোল-এ “সিটি অব লিয়ন্স” নামের একটি বিদেশী জাহাজ নোঙ্গর করে। বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজটির ছবি তিনি ক্যামেরাবন্দি করেন। তখন তিনি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। পিতা বাগেরহাট মহকুমার প্রশাসক। এ কারণেই তিনি বন্দরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর ধারণ করা ছবিটিই পরবর্তীতে বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রকাশিত ইয়ার-বুকে ছাপা হয়।
১৯৫৩ সালে মনিরুল হুদা বাগেরহাট টাউন হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৫৭ সালে একই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী কলেজ ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তবে বিশেষ কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। প্রত্যক্ষভাবে কখনোই রাজনীতির সাথে জড়িত হননি।
১৯৫৯ সালে তিনি আয়কর আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৬-২০১৯ বাংলাদেশ ট্যাক্স ল’ইয়ার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন।
সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহের কারণেই ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি দৈনিক পাকিস্তান-এ যোগ দেন। আত্মপ্রকাশের প্রথম দিন থেকে ১৯৯৭ সালে দৈনিক বাংলা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত তিনি খুলনা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ পত্রিকার ইতিহাসে তিনিই দীর্ঘদিনের কর্মী হিসেবে রেকর্ড সৃষ্টি করেন।
দৈনিক বাংলা থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বেশ কিছুদিন সংবাদপত্র হতে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। আবারও ২০০৬ সালের ১০ জানুয়ারীতে তিনি দৈনিক জন্মভূমি’র প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। আমৃত্যু তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিন কন্যা ও এক পুত্রের জনক ছিলেন।
খুলনা গেজেট/এইচ