সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা নিয়ে পোস্টমর্টেম বা ময়না তদন্ত নতুন কোন বিষয় নয়। বিশেষ করে গেল দেড় দশক ধরে এই পেশা এক প্রকার আইসিইউতে চলে গেছে। এখন অপেক্ষা শেষকৃত্যের। আমার লেখার এমন সূচনা দেখে যারপরনাই গালিগালাজ শুরু হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু একজন পেশাজীবী সংবাদ শ্রমিক হিসেবে এটি এক ধরণের জবানবন্দী। যাকে ভালবেসে সংসার, পরিবার ও সামাজিকতা ছেড়ে ছিলাম, আজকে তাকেই বড় বেমানান মনে হয়। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বীগ্ন থাকতে হয়। পরিবারের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান সংস্থানে দুচিন্তায় কপালে ভাঁজ ফেলতে হয়। অথচ সাংবাদিকতা ছিল ঐতিহ্য, সম্মান, শ্রদ্ধায় মাথা নত করা পেশা।
প্রচন্ড প্রতাপশালী, গুন্ডা-পান্ডা, দুর্নীতিবাজ, অসৎ ব্যক্তি অর্থাৎ সমাজের খারাপ মানুষরা এ পেশার মানুষদের ভয়ে থাকতো। আর এখন পরিস্থিতি উল্টো; এসব অসাধু মানুষের সাথে সখ্যতা যেন সাংবাদিকদের আভিজ্যত এনে দিচ্ছে। এই দৃশ্যেরও উল্টো দিকে যে কেউ নেই, তা নয়। তবে তাঁরা এখন নিতান্তই যাদুঘরের বাসিন্দা।
ব্যক্তিগতভাবে সব সময়ই আশা নিয়ে বেঁচে থাকার মানুষ আমি। তাই অনেক মান-অভিমান, ক্ষোভ-বিক্ষোভকে সহজেই দুরে ঠেলে দিয়ে এগিয়ে যেতে পছন্দ করি। ভস্মের অভ্যন্তরে সম্ভাবনার আলো দেখতে ভালবাসি। সত্যিই নিজের জীবনটাই একটা জীবন্ত আয়না। কী দেখছিলাম, দেখছি আর দেখবো এটাই একটা ইতিহাস। আমার মতো ঘাসফড়িংয়ের জীবনের মানুষ সেই ইতিহাসের বাইরে নয়।
আমি আগেই বলেছিলাম, গেল দশকের ব্যবধানে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকতা পেশাগতভাবে মর্যাদা হারিয়ে চলছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও সাংবাদিকতা একটি স্বতন্ত্র পেশা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি। গড়ে উঠেনি একটি সুনিদিষ্ট নীতিমালা। যোগ্যতা-অযোগ্যতার মাপকাঠি না থাকায় হরহামেশা যেমন কথিত সংবাদ মাধ্যম গড়ে উঠছে, নানা রকমফের সাংবাদিক তৈরী হচ্ছে।
পেশার এ সংকটের মধ্যে দিয়ে একটি সুবিধাভোগী, লাঠিয়াল, দুর্নীতিবাজ ও ধান্ধাবাজ শ্রেণি গড়ে উঠছে। যাদের যাঁতাকলে মূলত বারোটা বেজে গেছে। একটু সাদা চোখে এদেশের সাংবাদিকতার পুরনো ইতিহাস ঘেটে দেখা যাবে, মূলত: সমাজের শিক্ষিত, ভদ্র, মেধাবী, সৎ ও আদর্শিক মানুষেরাই এই পেশায় যুক্ত হতেন। যাদের সিংহভাগ ছিলেন শিক্ষক, আইনজীবী, সাংস্কৃতিক ও মেধাবী ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। কিন্তু দিন দিন সেই অবস্থা থেকে সাংবাদিকতা সরে এসেছে। এখানে কাউকে ছোট করছি না। এখন ভ্যান-রিক্সা, ইজিবাইক, বাস, ট্রাক মালিক, শ্রমিক, ড্রাইভার, মাছ ব্যবসায়ী, চা-পান-বিড়ির দোকানদারও এ পেশায় দাপট দেখাচ্ছেন। আবার তথ্য-প্রযুক্তি প্রসারে সোশ্যাল মিডিয়া দেখলেতো সাংবাদিকদের সত্যিকার পরিসংখ্যান বের করা খুব কঠিন। সত্য-মিথ্যা তথ্যের আড়ালে চলছে নানা প্রতারণা-হযরানি। কোন কোন ক্ষেত্রে বাক স্বাধীনতার নামে নীতি-নৈতিকতার মাথা খেয়ে চলে চরিত্রহরণের মহাৎসব।
আমি মনে করি, সাংবাদিকতা কোনকালেই রাজনীতির বাইরে ছিল না। এদেশে প্রথিতযশা সাংবাদিকরা সুনিদিষ্ট মতাদর্শের মধ্যে থেকে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেছেন। তারা সকলেই রাজনীতিকে মননে ধারণ করেছেন, কিন্তু লাঠিয়ালে রূপ দেননি।প্রখ্যাত সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবুল মনসুর আহমেদ, এবি এম মুসা, কে জি মোস্তফা, নির্মল সেন, ফয়েজ আহমেদ, আতাউস সামাদ, তোয়াব খান, কামাল লোহানী, গোলাম সরোয়ার, সন্তোষ গুপ্ত- এমন আরো অনেকের নাম বলা যায়।
খুলনার সাংবাদিকতায় ৮০, ৯০ দশকে অনুকরণীয় ছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক মনিরুল হুদা, প্রয়াত আবু সাদেক, আইয়ুব হোসেন, সাহাবুদ্দিন আহমেদ, মানিক চন্দ্র সাহার মতো মানুষেরা। তাঁরাও সুনিদিষ্ট নীতি আদর্শ মেনে চলেছেন। কেউ কেউ কোন মতাদর্শকে বিশ্বাস করলেও সেটি তাঁরা কখনো পেশার পেশীশক্তি হিসেবে ব্যবহার করেননি। ফলে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জয় হয়েছে। কিন্তু ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের এখনকার সাংবাদিকতা লাঠিয়াল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমরা সাংবাদিকতার চেয়ে রাজনৈতিক মতপথকে গুরুত্ব দিচ্ছি। সাংবাদিক মানেই অবৈধ জমির মালিকানা, জুয়া, মাদক নিয়ন্ত্রণ। অবৈধ কর্মকান্ড-অনৈকতা থেকে সুবিধা আদায়। আর অল্প সময়ের মধ্যে অর্থ-বিত্তে ফুলে-ফেঁপে ওঠা, অসাধু কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় আরো কত কী। মূলত: সুবিধা আদায়ের এই দৈন্যতাই সাংবাদিকতা নামক মহান পেশাকে কলুষিত করছে। আপোষকামিতা, পদলেহন, দলীয় লেজুড়বৃত্তি পেশাটিকে ধ্বংসের খাদের কিনার থেকে আইসিইউতে নিয়ে গেছে। এখন শুধু মৃত্যুর অপেক্ষা!
সত্যিকার অর্থে এতো প্রতিকূল অবস্থার মধ্য পেশাদার সাংবাদিকতা করা ও নতুনভাবে সৃষ্টি হওয়া সত্যিকার অর্থে ‘আমড়া গাছে, আম’ প্রত্যাশার মতো মনে হবে। এই সিন্ডিকেট ও গন্ডি পাড় হওয়া কষ্টকর। অনেকেই বাক স্বাধীনতার সংকটের অভিযোগ করেন। কিন্তু বাস্তব অবস্থা কী তাই? কথিত মিডিয়াগুলোতে চোখ বুলালে সেই বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। সংকটটি এখন দালাল, লেজুড়ে সাংবাদিকতায়। একমাত্র প্রকৃত ও পেশদারিত্ব সাংবাদিকতাই এই পেশার ঐতিহ্য ফেরাতে পারে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানী চালর্স ডারউইনের বিখ্যাত উক্তি অনুস্মরণীয় হতে পারে ‘যোগ্যতমের জয় অনিবার্য’। তাই একজন সংবাদ শ্রমিক হিসেবে সাংবাদিকের সাংবাদিকতা দেখতে চাই। পেশা হিসেবে রুটি-রুব্জির নিশ্চয়তা চাই। চাই সাংবাদিকতার সুনিদিষ্ট রাষ্ট্রীয় নীতিমালা।
শেষ করতে চাই কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ‘চিত্ত যেথা ভয়শূণ্য’ কবিতার আমার প্রিয় কয়েকটি লাইন দিয়ে।
‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি,’
লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ
খুলনা গেজেট/এমএম