আনোয়ারা বেগম (৬০)। স্বামীর মৃত্যুর পর নিজেদের কোন জমি বা ঘরবসতি না থাকায় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী একমাত্র ছেলে আশাকে নিয়ে ১০ বছর ধরে বসবাস করতেন কবরস্থানে। সেখানে একপাশে খড়কুড়ো দিয়ে মাটির ঘর তৈরি করে ছেলেকে নিয়ে কোনরকমে মাথাগোঁজার ঠাই করেছিলেন। মা-ছেলে দু‘জনেই অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করে জীবন চালাতেন। ফলে নিজের কোন ঘরবসতির কথা স্বপ্নেও ভাবেননি আনোয়ারা বেগম। তবে সেটিই সত্য হয়েছে। সরকারের টিআর প্রকল্পের আওতায় দুর্যোগ সহনীয় বাড়ি পেয়েছেন তিনি।
স্থানীয়রা জানায়, কবরস্থানের একপাশে বসতি গড়েছিলেন আনোয়ারা। প্রথমে ভয়-ভীতিতে অনেক রাতই নির্ঘুম কাটিয়েছেন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে। তার ওপর আবার যেদিন কবরস্থানে কোন লাশের দাফন হতো সেদিন ভয়ে অন্যের বাড়ির বারান্দায় রাত কাটিয়েছেন তারা। এভাবেই দীর্ঘ ১০ বছর কবরস্থানেই বসবাস করেছেন হতদরিদ্র অসহায় আনোয়ারা বেগম। তিনি ঝিনাইদহের হরিনাকুণ্ডু উপজেলার পারদখলপুর গ্রামের মৃত বিশারত আলীর স্ত্রী।
আনোয়ারা বেগমের এই অসহায়ত্ব নিয়ে কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ও সোস্যাল মিডিয়াতে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দা নাফিস সুলতানার নজরে এলে তিনি কয়েকজন গনমাধ্যম কর্মীকে নিজ কার্যালয়ে ডেকে আনোয়ারা বেগমকে সহায়তার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। তিনি ওইদিনই নিজ কার্যালয়ের এক কর্মকর্তাকে পাঠান কবরস্থানে আনোয়ারা বেগমের অসহায়ত্ব দেখতে। পরে তিনিও সেখানে পরিদর্শনে যান। প্রতিশ্রুতি দেন আনোয়ারাকে একটি ঘর দেওয়ার। কিন্তু অসহায় আনোয়ারা বেগমের নিজের কোন জায়গা-জমি না থাকায় ঘর তৈরিতে দেখা দেয় জটিলতা। আবারও তার পাশে দাঁড়ান ইউএনও। তিনি সরকারি জায়গার ব্যবস্থা করে সেখানেই শুরু করেন আনোয়ারা বেগমের জন্য ঘর তৈরির কাজ। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন ঘর তৈরির।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়ের গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) প্রকল্পের আওতায় তিন লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি কক্ষ, একটি টয়লেট ও একটি রান্নাঘর বিশিষ্ট দুর্যোগসহনীয় বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে আনোয়ারার জন্য।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ জামাল হোসাইন বলেন, প্রায় তিন লাখ টাকা ব্যয়ে আনোয়ারা বেগমের জন্য দুর্যোগ সহনীয় বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। সেখানে স্থাপন করা হয়েছে একটি চাপকলও। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজে উপস্থিত থেকে ইতোমধ্যে ওই অসহায় মা-ছেলেকে ঘর বুঝিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে তারা সেখানে বসবাস করছেন।
শুক্রবার সরেজমিনে আনোয়ারা বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছেলে আশাকে নিয়ে ঘরের বারান্দায় আপন মনে গল্প করছেন। নতুন ঘর পাওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি নিজের একটি বাড়ি হবে। তিনবেলা ঠিকমতো খাবারই জোটে না, তাই বাড়ির স্বপ্ন কখনও দেখিনি। আপনাদের কাছে জেনে ইউএনও আমাকে একটি বাড়ি দিয়েছেন। তার ওপর আবার পাকা বাড়ি। এটা আমার রাজপ্রাসাদ।
তিনি বলেন, ইউএনওর মতো এমন দয়ালু মানুষ কোনদিন দেখিনি। এখন আর শেয়াল-কুকুরের ভয় নেই। জীবনে অনেক রাত ভয়ে না ঘুমিয়েই কাটিয়েছি। এখন খাই, না খাই অন্তত রাতে আরামে মা-ছেলে ঘুমাতে পারি। যখন ঘরের কাজ শুরু হয় তখন ইউএনও প্রায়ই আসতেন। মাঝে মাঝেই আমাদের জন্য চাল, ডাল, আলু, তেলসহ নানা খাবার দিয়ে যেতেন। এখনও তিনি আমার খোঁজ নেন। আল্লাহ এমন দয়ালু আর ভালো মানুষকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখুক।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দা নাফিস সুলতানা বলেন, সমাজের এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব। রাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা হিসেবে নয়, জনগণের সেবক হিসেবে তাদের পাশে থেকে সেবা করতে চাই। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মুজিব বর্ষে দেশের কোন মানুষ গৃহহীন থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে অসহায় আনোয়ারা বেগমের জন্য বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।
খুলনা গেজেট/নাফি