যখন দু’জন মানুষ প্রেমে পড়ে, তখন তাদের মধ্যে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্নেহ এবং একে অপরের প্রতি গভীর যত্ন ও উদ্বেগ থাকে। কিন্তু অনেক সময় এই যত্ন কিংবা উদ্বেগ কখন নিয়ন্ত্রণ, অপমান কিংবা মানসিক-শারীরিক নির্যাতনে রূপ নিচ্ছে, তা অনুধাবন করাও কঠিন হয়ে ওঠে। আমাদের সমাজে ‘নির্যাতন’ শব্দটি বলতেই প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শারীরিক নিগ্রহের ছবি। অথচ মানসিক এবং অর্থনৈতিক নির্যাতনও ঠিক ততটাই ক্ষতিকর—অথচ এই দুই প্রকার নির্যাতনকে আমরা বহু সময় ‘সম্পর্কের অংশ’ বলে ভুল করি। ভারতীয় গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে মানসিক নির্যাতনের প্রসঙ্গে বিস্তারিত উঠে এসেছে।
ভুল বোঝাবুঝি সব সম্পর্কেই হয়। কিন্তু যখন সেই সম্পর্কের মূলভিত্তি ভালোবাসার বদলে ভয়, শ্রদ্ধার বদলে নিয়ন্ত্রণে পরিণত হয়, তখন তা হয়ে ওঠে বিষাক্ত। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যেসব সম্পর্কে ‘আবেগগত সমতা’ বজায় থাকে, সেসব সম্পর্কেই উভয় সঙ্গীর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
‘হেলথ সাইকোলজি রিসার্চ’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ নারীরা সম্পর্কের মধ্যে চলমান শোষণ ও নির্যাতন উপেক্ষা করেন। আবার ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ইন্ডিয়ান সাইকোলজি’–তে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, বহু ভারতীয় নারী মানসিক নির্যাতনকে ‘স্বাভাবিক’ বিষয় মনে করেন। অথচ এই ধরনের সম্পর্ক মানসিকভাবে অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, এমনকি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতাও দুর্বল হয়ে পড়ে।
যেসব লক্ষণ থেকে বুঝবেন মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন: অনেকেই বুঝতে পারেন না তারা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তবে কিছু লক্ষণ দেখলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায় বলছেন মনোবিজ্ঞানী ও সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ নেহা পরাশর। যেসব লক্ষণের দিকে নজর দিতে হবে-
সবসময় ভয় ও মানসিক চাপ অনুভব করা: যদি সারাক্ষণ মনে হয়, আপনার সঙ্গীকে কীভাবে খুশি রাখা যায়, কী বললে রেগে যাবে—এই চিন্তায় দিন কাটে, তাহলে এটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত যে সম্পর্কটি নিয়ন্ত্রণমূলক হয়ে উঠেছে।
আপনার অনুভূতিকে অস্বীকার করা: যখন আপনার সঙ্গী ‘তুমি ভুল বুঝছো’, ‘তুমি সবকিছু অতিরিক্ত ভাবো’—এই ধরনের মন্তব্য করবে তখন সাবধান হতে হবে। কারণ এসব মানসিক নির্যাতনের অন্যতম চিহ্ন। এটি ধীরে ধীরে আপনার আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে দেয়।
মানসিক অবহেলা ও অবমাননা: যখন সঙ্গী আপনার অনুভূতিকে গুরুত্ব না দিয়ে বারবার ছোট করে কথা বলে কিংবা অপমান করে, তখন সেটিও এক ধরনের মানসিক শোষণ।
সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া: বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা সহকর্মীদের থেকে আপনাকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা মানে আপনার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়া।
অর্থনৈতিক নির্যাতন: যখন সঙ্গী আপনার খরচ নিয়ন্ত্রণ করে, কাজ করতে বাধা দেয় কিংবা অর্থ দিয়ে হুমকি দেয়—তখন সেটা অর্থনৈতিক নির্যাতনের চিহ্ন।
শারীরিক সহিংসতা: একটি বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের মধ্যে ৩২ শতাংশই স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার। যেকোনো ধরনের শারীরিক হুমকি, চিৎকার বা মারধর স্পষ্টভাবে সহিংসতার আওতায় পড়ে।
এ ধরনের সম্পর্ক মোকাবেলার ৫টি উপায়: মনোবিদরা মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধের বেশ কিছু উপায় উল্লেখ করেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে-
নিজের অনুভূতির উপর আস্থা রাখা: যদি বারবার মনে হয় “কিছু একটা ঠিক নয়”, তবে সেই অনুভূতিকে গুরুত্ব দিন। সঙ্গীর উপস্থিতিতে যদি ভয় কাজ করে, তাহলে সেটা উপেক্ষা করবেন না।
নীরবতা ভাঙুন: বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা কাউন্সেলরের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন। কারও সঙ্গে শেয়ার করাই প্রথম ধাপ
প্রমাণ রেখে দিন: যদি নিরাপদ মনে করেন, তাহলে নির্যাতনের ঘটনাগুলোর অডিও বা লিখিত রেকর্ড রাখুন। ভবিষ্যতে এটি আইনি সহায়তার ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে।
সহায়তা খুঁজে নিন: মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, হেল্পলাইন বা সহায়ক গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। নিজেকে একা না ভেবে সমাধানের পথ খুঁজে বের করুন।
নিজেকে দোষারোপ বন্ধ করুন: এই পরিস্থিতির জন্য তুমি দায়ী নও। নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন এবং নিজের আত্ম-মর্যাদা ফিরে পাওয়ার জন্য সময় দিন।
ভালোবাসার সম্পর্ক শ্রদ্ধা ও সমতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। সেখানে ভয়, দমন-পীড়ন কিংবা নিয়ন্ত্রণের কোনো স্থান নেই। যদি তুমি এমন এক সম্পর্কে থাকো যেখানে নিজেকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত মনে হচ্ছে, তাহলে দয়া করে চোখ বন্ধ করে সহ্য করে যেও না। নিজের জন্য, নিজের ভবিষ্যতের জন্য—একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। পরিবর্তন সম্ভব, আর সেই পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে আজ থেকেই।
খুলনা গেজেট/জেএম