ওষুধ কিংবা স্যালাইনের কোন সংকট নেই। পর্যাপ্ত ওষুধ এবং স্যালাইন স্টোরে মজুদ রয়েছে। সংকট জনবলের। বর্তমানে ২ জন চিকিৎসক, ৬ জন নার্স এবং ১ জন পিয়ন দিয়ে চলছে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম। সকাল ৮ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত টানা ১২ ঘন্টা একজন চিকিৎসককে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। হাসপাতালটিতে রাত ৮ টার পর পাওয়া যাচ্ছে না কোন চিকিৎসক। রাতে ইমারজেন্সি কোনো রোগী আসলে চিকিৎসক তার বাসা থেকে অন কলে মোবাইলে ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে হাসপাতালটি। ন্যূনতম কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। কর্তব্যরত নার্স এবং চিকিৎসক দিবারাত্রি সর্বদা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করনে। দীর্ঘদিন আগে হাসপাতালের পূর্ব পাশের সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে গেলেও অধ্যাবধি মেরামত করা হয়নি। বহিরাগতরা অবাধে প্রবেশ করে হাসপাতালের অভ্যন্তরে। হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য নেই কোন আয়া কিংবা সুইপার। আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক কাজ করা কর্মচারীরা গত ১৫ মাস যাবৎ বেতন পাচ্ছে না। তারাও কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। হাসপাতালের আবাসিক কোয়ার্টারগুলো দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত। জঙ্গলময় পরিবেশ বিরাজ করছে।
রাতে চিকিৎসক না থাকায় কর্তব্যরত নার্সদের বাড়তি চাপ সামলাতে হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন নার্স বলেন, রাতে ডিউটিতে চিকিৎসক না থাকার কারণে আমাদেরকে সামলাতে হচ্ছে। এছাড়া মাঝে মধ্যে কিছু অনভিব্রত ঘটনাও ঘটছে।
গত মঙ্গলবার (২ অক্টোবর) দিবাগত রাত আনুমানিক তিনটার দিকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত একজন বাচ্চা রোগীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে আসেন তার স্বজনরা। ডাক্তার ছাড়া বাচ্চার চিকিৎসা দেওয়া যাবে না, একথা বলার পর রোগীর অভিভাবকরা উত্তেজিত হয়ে আমাদের উপর মারাত্মক চড়াও হয়। এভাবে প্রতিনিয়ত আমাদেরকে ভয় এবং আতংকের মধ্যে ডিউটি করতে হচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ইতিপূর্বে পূর্বে চারজন চিকিৎসক ডেপুটেশনে হাসপাতালটিতে দায়িত্ব পালন করতেন। কর্তৃপক্ষ গত সপ্তাহে তাদের সংযুক্তির আদেশ বাতিল করে স্ব স্ব কর্মস্থলে যোগদান করার নির্দেশনা প্রদান করেন। বর্তমানে হাসপাতালটিতে কর্তব্যরত চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র দুইজন। এর মধ্যে একজন পুরুষ চিকিৎসক অন্য একজন মহিলা চিকিৎসক।
জানা যায়, স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬৮ সালে খুলনার খানজাহান আলী থানার ফুলবাড়িগেট মীরেরডাঙ্গায় ৪ একর জায়গার উপর নির্মিত হয় খুলনা বিভাগীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। নির্মাণের পর দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ দশকেও বিভাগীয় এ হাসপাতালটিতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। ৫৬ বছর পূর্বে হাসপাতালটির নির্মাণ কাঠামো যেমনটি ছিলো ঠিক তেমনটিই রয়ে গেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আধুনিকায়ন কিংবা শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি এর কিছুই হয়নি। হাসপাতালের চারদিকে সীমানা প্রাচীরগুলো ভেঙ্গে গেছে। কোন নিরাপত্তা প্রহরি নেই। গরু ছাগল এবং বহিরাগতরা অবাধে হাসপাতালের অভ্যন্তরে বিচরণ করে। রাতে নৈশ্যপ্রহরী না থাকার কারণে ভর্তিকৃত রোগী তাদের স্বজন, কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স সবাই ভয় এবং আতঙ্কের থাকেন।
হাসপাতালটিতে কোন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকার কারণে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশু রোগীদের চিকিৎসা সেবা সঠিকভাবে মিলছে না।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ডায়রিয়া রোগীর প্রচুর চাপ থাকে। হাসপাতালটি থেকে বছরে পাঁচ সহস্রাধিক ডায়রিয়ার রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। সম্প্রতি বছরগুলোতে খুলনাঞ্চলে তাপদাহ বৃদ্ধির কারণে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০ শয্যার এ হাসপাতালটিতে ডায়রিয়া, টিটিনাস, জলবসন্ত, জলাতঙ্কসহ সকল প্রকার সংক্রামক রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। তন্মধ্যে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ। বাকী সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা খুবই সীমিত।
খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা, উপজেলা এবং পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর থেকে প্রতিদিন হাসপাতালটিতে ২৫/৩০ জন ডায়রিয়ার রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। গরমের তীব্রতা বাড়লে এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। আগত রোগীদের মধ্যে ১০/১৫ জন রোগীকে ওয়ার্ডে ভর্তি করে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। বহিঃর্বিভাগে রোগী দেখার ব্যবস্থা না থাকায় বাকী রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
সূত্রমতে, ডায়রিয়া রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ থাকলেও স্টোরেজ ব্যবস্থা না থাকার কারণে হাসপাতালটিতে সংক্রমিত রোগের কোন ভ্যাকসিন পাওয়া যায় না।
২০ শয্যার হাসপাতালটিতে ডায়রিয়া রোগীর জন্য শয্যা রয়েছে মাত্র ১০ টি। বাকী ১০ শয্যার মধ্যে ৫ টি টিটিনাস ও ৫ টি হাম বসন্ত ও অন্যান্য সংক্রামক রোগের জন্য নির্ধারিত।
হাসপাতালটিতে মহিলা পুরুষ এবং শিশুদের জন্য আলাদা কোনো কেবিন না থাকার কারণে একই ওয়ার্ডে পুরুষ, মহিলা এবং শিশু রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি মহিলাদের জন্য আলাদা কোনো টয়লেটেরও ব্যবস্থা নেই।
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও মেডিকেল অফিসার ডাঃ মোঃ হাবিবুর রহমান খুলনা গেজেটকে বলেন, সিভিল সার্জন, মাননীয় পরিচালক স্যার উনারা সবাই জানেন এই হাসপাতালের পরিস্থিতি সম্পর্কে। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার অবগত করা হয়েছে নতুন করে ভবন নির্মাণ করা যায় কিনা? নতুন পদ সৃষ্টি করা যায় কিনা? শিশু কনসালটেন্ট পদ সৃষ্টি করা যায় কিনা? হাসপাতালের চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি পরিচালক স্যারও অবগত আছেন। তিনি আমাদেরকে দ্রুত ডাক্তার দেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে প্রচুর শিশু রোগী আসে। কিন্তু শিশু কনসালটেন্ট চিকিৎসক না থাকার কারণে খুব ছোট বাচ্চাদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সংগত কারণেই শিশু রোগী আসলে আমাদেরকে খুলনা মেডিকেল কলেজ এবং শিশু হাসপাতালের রেফার্ড করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, খুলনার ৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে, সরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল এবং পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো থেকে এখানে প্রচুর রোগী রেফার্ড হয়ে আসতেছে। অফিশিয়ালি আমাদের এখানে ডায়রিয়া রোগীর জন্য মাত্র ১০ টি বেড রয়েছে। আমরা নিজেরা ৫ বেডের ব্যবস্থা করে ১৫ টা করেছি। ১৫ জন রোগী ভর্তির পর ১৬ নং থেকে ভর্তিকৃত রোগীদেরকে ফ্লোরিং করতে হচ্ছে। আমরা সর্বদা চেষ্টা করি রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার।
দুইজন চিকিৎসক দিয়ে চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে খুলনা সিভিল সার্জন ডাঃ শেখ সফিকুল ইসলাম খুলনা গেজেটকে বলেন, ওইটা অফিসে আসলে আমি স্পিচ দিবো, মোবাইলে বলা যাবে না। ডাক্তার দেওয়ার এখতিয়ার আমার না।
চিকিৎসক স্বল্পতার বিষয়ে খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ মোঃ মনজুরুল মুরশিদ বলেন, ডাক্তার তো আমরা দেয় না ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আছেন তারা পোস্টিং দেয়। আমরা তাদেরকে অবহিত করেছি। কিছুদিন গেলে আমরা ডেপুটেশনে ডাক্তার দেওয়ার ব্যবস্থা করব। এখন অনেক উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও ২/১ জন চিকিৎসক দিয়ে চলছে।
খুলনা গেজেট/এনএম