আমাদের সমস্যাগুলো সাধারণ হলেও, সেগুলোর সমাধান প্রায়শই জটিল হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন রাস্তায় একটি ছোট গর্ত হলো। প্রথমে ছোট গর্ত, তারপর সেটি বড় হতে হতে পুকুরের মতো হয়ে গেল, আর অবশেষে এমন সময় এল যখন সেই রাস্তা দিয়ে চলাচলের সময় কেউ দুর্ঘটনায় মারা গেল।
তখন এলাকার জনগণ জেগে উঠল। আন্দোলন শুরু হলো, মানববন্ধন করা হলো। এতকিছুর পরেও কি রাস্তা সংস্কার হলো? না, ভুল ভাববেন না। ঐ ঘটনার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো, তাদেরকে রিপোর্ট দিতে বলা হলো। সেই রিপোর্ট আর কোনোদিন লেখা হবে না এবং জনগণের সামনেও আসবে না। ততদিনে রাস্তা খাল থেকে নদী হয়ে যাবে। যে রাস্তা ঠিক করতে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হত, সেই রাস্তা ঠিক করতে এখন এক কোটি টাকা খরচ হবে। এই অতিরিক্ত খরচকে বলা হয় রাষ্ট্রের টাকার অপচয়।
সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্তব্যের অবহেলা আর গাফিলতির কারণে এই অপচয় হয়। অবশ্য এই গাফিলতির জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না। অথচ সমাধান ছিল খুবই সহজ—সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা খুব সহজেই গর্তটা ভরাট করে রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক করতে পারত। এই সমস্যার মূল কারণ হলো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা এবং কালক্ষেপণ।
অন্যদিকে একটি স্থিতিশীল ইস্যুকে আবার অস্থিতিশীল করতে আমাদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালের একটি সমাধানকৃত ইস্যুকে ২০২৪ সালে পুনরায় উত্থাপন করে ছাত্রদের রাস্তায় নামানো হলো। স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছর ধরে কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হয়ে আসছে, এর ফলে কি দেশ উপকৃত হয়েছে নাকি শুধু কিছু ব্যক্তি ও তাদের পরিবার উপকৃত হয়েছে? আমাদের প্রশাসন কি পৃথিবীর এক নম্বর প্রশাসন হতে পেরেছে? আমাদের পুলিশ বাহিনী কি সেবার দিক দিয়ে এক নম্বর হতে পেরেছে? আমাদের বিচার বিভাগ কি আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পৃথিবীর এক নম্বর বিচার ব্যবস্থা হতে পেরেছে? তাহলে এই কোটা ব্যবস্থা রেখে দেশের উপকার কি?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে স্পষ্ট দেখা যায় যে, দেশের সার্বিক উন্নতি হয়নি বরং কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী উপকৃত হয়েছে। এমন একটি ব্যবস্থা রেখে যদি দেশের উন্নতি না হয়, তবে এই সমস্যার সমাধান কি?
খুবই সহজ: প্রতিবন্ধী ও উপজাতীয় কোটা রেখে সকল ক্ষেত্রে মেধার মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করা হোক। মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারকে অন্যভাবেও সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো যেতে পারে যেমন বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা, বাড়ি নির্মাণ, ট্যাক্স মওকুফ, মাসিক ভাতা। সর্বোপরি রাষ্ট্রের সকল সেবা ও সুবিধা তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ফ্রি করে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু, কেবল কোটা সিস্টেমের মাধ্যমে যদি কিছু বিশেষ গোষ্ঠীই সব সুবিধা পায়, তবে সাধারণ জনগণ কোথায় যাবে? তাদের কি কোনো মূল্য নেই? দেশের প্রকৃত উন্নতির জন্য কি শুধুমাত্র মেধাই যথেষ্ট নয়? সময় এসেছে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার এবং একটি ন্যায্য ও সুষ্ঠু ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। এই সমস্যা সমাধানেও সংশ্লিষ্টের কালক্ষেপণ করতে দেখা যাচ্ছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও অবহেলার দৃষ্টান্ত রয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এক ধরনের নির্মম ও অদ্ভুত ব্যবস্থা বিদ্যমান। সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার সময় বলা হয়, “আপনারা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, তাই এই সুযোগ পাবেন না।” আবার সুবিধা কাটার সময় বলা হয়, “আপনারা সরকারি প্রতিষ্ঠান, তাই এই নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।”
এই দ্বৈত নীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেশাগত নিরাপত্তা প্রচলিত পেনশন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে প্রত্যয় নামক পেনশন স্কীমে অন্তর্ভুক্ত করে, তাদের সংগ্রামের পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। যারা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলছে, তাদের প্রতি এই অবিচার? অথচ এই সমস্যার সমাধান ছিল একেবারে হাতের নাগালে, কিন্তু তবুও কেন এই অবহেলা? শিক্ষকদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে একটি যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব ছিল। কিন্তু প্রশাসনের উদাসীনতা ও অবজ্ঞার কারণে শিক্ষকদের এই দুরবস্থা। একজন শিক্ষক কেবলমাত্র একজন পেশাদার নন, তিনি আমাদের সমাজের আলোর দিশারী। তিন মাস ধরে আন্দোলন করলেও শিক্ষকদের সমস্যা সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে।
আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে সমস্যাগুলো জটিলতর হয়ে ওঠে। ম্যাক্স ওয়েবার ১৯২২ সালে বুরোক্রেসি থিয়োরি প্রবর্তন করেন। এই তত্ত্বের মাধ্যমে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে শাসন করেছিল। কিন্তু বর্তমানে খোদ ব্রিটেনেই এই আমলাতন্ত্রের প্রচলন নেই। আধুনিক সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই আমলাতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে আরও কার্যকর তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। আমলাতন্ত্রের বিপরীতে বর্তমানে জনপ্রিয় কিছু প্রশাসনিক কাঠামো হল Adhocracy, Flat Organization, Holacracy, Networked Organization, Agile Organization, Team-Based Organization এবং Matrix Organization। এখন আমরা ২০২৪ সালে এসেও ১৯২২ সালের এই পুরনো তত্ত্ব দিয়ে দেশ চালাচ্ছি। আমলাতন্ত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা এবং কালক্ষেপণ করা। আপনি বাংলাদেশের যেদিকেই তাকান না কেন, সর্বত্রই এই দীর্ঘসূত্রিতা এবং কালক্ষেপণের নিদর্শন দেখতে পাবেন।
আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হলে এই আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে এবং আরও কার্যকর ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। একটি কার্যকর প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হলে আধুনিক তত্ত্ব ও কৌশলগুলোকে প্রয়োগ করতে হবে। তবেই আমরা আমাদের সমস্যাগুলোর সহজ ও কার্যকর সমাধান খুঁজে পাব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
Email: mourtuza@ku.ac.bd