পেনশন নিয়ে শিক্ষক এবং সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে যে সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা দ্রুত নিরসনে সমঝোতার কোনো লক্ষণ ও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ছাত্র ও শিক্ষকদের এ আন্দোলনে শিক্ষাঙ্গনে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি ছাত্রদের সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের কারণে জনদুর্ভোগও বেড়েছে। শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দিয়েছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ তারা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পেনশন বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে এবং কোটা আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নীরব রয়েছে। এ অবস্থায় এ আন্দোলন ভবিষ্যতে কোন পথে এগোবে, এর পরিণতিই-বা কী হবে, অচলাবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটবে কীভাবে-এসব প্রশ্ন পর্যবেক্ষকদের কাছে বড় হয়ে উঠেছে।
সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনকে খুবই স্পর্শকাতর হিসেবে বিবেচনা করছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা যেন সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে না দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে সতর্ক তারা। তবে সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচির বিরুদ্ধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক আন্দোলন নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয় সরকার। শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে সরকার এখনো ছাড় না দেওয়ার অবস্থানে রয়েছে।
কোটাবিরোধী এই আন্দোলনের মূল শক্তি সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। এমন বাস্তবতায় সরকারের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও রাজনৈতিক দিক থেকে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থী আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কোনো বাধা না দিতে ছাত্রলীগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিও শক্তি প্রয়োগ না করার নির্দেশনা রয়েছে।
কোটা বিরোধী আন্দোলন কেন
২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল বাংলাদেশে। তার মধ্যে ৩০ শতাংশই ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা।
বাকি কোটার মধ্যে ছিল ১০ শতাংশ নারী কোটা ও ১০ শতাংশ জেলা কোটা। ৫ শতাংশ কোটা ছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য। এ ছাড়া এক শতাংশ কোটা ছিল প্রতিবন্ধীদের।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তাদের দাবি ছিল, কোটা ৫৬ শতাংশ না হয়ে ১০ শতাংশ করা হোক।
তাদের দাবির মুখে সে বছর পুরো কোটা পদ্ধতিই বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরে পেতে উচ্চ আদালতে রিট করেন। এ রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ জুন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের ওই রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের এই রায় স্থগিত না করায় আগের নিয়মানুযায়ী সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আপাতত বহাল রয়েছে ।
হাইকোর্টের ওই রায়ের পর গত ৬ জুন থেকেই তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। তবে কিছুদিন আন্দোলন চললেও মুসলমানদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা চলে আসায় ২৯ জুন পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখেন শিক্ষার্থীরা। গত ৩০ জুন থেকে তারা ফের আন্দোলন শুরু করেন। পহেলা জুলাই থেকে এই আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
শিক্ষকদের দাবি আদায়ে অনড়
ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি শিক্ষক আন্দোলনে ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অচল হয়ে পড়েছে। শিক্ষকেরা মনে করেন, পেনশনের প্রত্যয় কর্মসূচিতে তাঁদের সুবিধা অনেক কমানো হয়েছে। তবে শিক্ষকদের এ আন্দোলনকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না সরকার। কারণ, বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলোর নেতৃত্বে সরকার–সমর্থক শিক্ষকেরাই রয়েছেন। তাঁদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না, এমন ধারণা আছে সরকারের ভেতরে। ফলে সরকার এ নিয়ে তেমন চিন্তিত নয়।
একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, তাঁদের শীর্ষ নেতৃত্ব সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি থেকে সরে আসবেন না বলে তাঁরা মনে করেন। সে কারণে সরকার এখনো শিক্ষকদের দাবিতে ছাড় দেওয়ার অবস্থানে নেই। তবে তাঁরা আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষক আন্দোলনের ব্যাপারে সমাধান চাইছেন। সে জন্য শিক্ষকনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। যদিও এর আগে বৈঠক করার কথা বলা হলেও তা হয়নি। আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, আলোচনার ব্যাপারে সময় নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আলোচনা তাঁরা করবেন।
খুলনা গেজেট/এইচ এইচ