জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে বিশ্ব মানবাধিকার দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর ৭৪তম বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য- সবার জন্য মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার। স্বাধীনতা যে কোনো জাতির পরম আকাক্সিক্ষত বিষয়। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভ, গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজ গঠন, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন, জানমালের নিরাপত্তা বিধান, ধর্ম পালন, নিজস্ব সংস্কৃতি-মূল্যবোধ- বিশ্বাসের অবারিত চর্চা নিশ্চিত করা ইত্যাদি বাস্তবায়নের জন্য মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিটি দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য অপরিহার্য।
মানবাধিকার জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। আমরা জানি. ফরাসি বিপ্লবের মূলনীতি ছিল সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ব যা মানবাধিকারেরও মূলভিত্তি। স্বাধীনতা ছাড়া মানবাধিকারের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। আবার ন্যায়বিচার ছাড়া ব্যক্তির স্বাধীনতা ধরে রাখা সম্ভব নয়। সেই দিক বিবেচনায় মানবাধিকার সংরক্ষণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে সামাজিক ন্যায়বিচার। সামাজিক ন্যায়বিচার বলতে সমাজের এমন এক পরিবেশকে বোঝায়, যেখানে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার সমানভাবে বেঁচে থাকা, জীবনযাপন এবং কাজ করার সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়। সামাজিক ন্যায়বিচার যেমন অগ্রগতি, সমৃদ্ধি, সম্পদের সুষম বণ্টনের সুযোগ নিশ্চিত করে, তেমনি বয়স-বর্ণ-ধর্ম-লিঙ্গ বা শারীরিক পার্থক্যের কারণে সৃষ্ট বৈষম্যকেও নির্মূল করে।
গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল-এর মতে, যে ব্যক্তি দেশের আইন লঙ্ঘন করে অথবা তার যা প্রাপ্য তারচেয়ে বেশি গ্রহণ করে, সে অন্যায়কারী অথবা ন্যায়বিচার বিরোধী। অর্থাৎ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ন্যায়বিচারের ভিত্তি। অন্য কথায় সমাজে আইন প্রণীতই হয়ে থাকে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। একইভাবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মুল ভিত্তি হচ্ছে এই আইন। আবার মানুষের তৈরি আইন ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে অনেক আইন, নিয়ম-কানুন রয়েছে সেগুলোও মানবাধিকার তথা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কৌশল হিসেবে কাজ করে।
আধুনিক সমাজ বা রাষ্ট্রনীতিতে একটি দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হলো সামাজিক ন্যায়বিচার। যে সমাজ বা রাষ্ট্রে সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রয়োগ আছে, সে রাষ্ট্র বা সমাজ ততটা উন্নত এবং সমৃদ্ধ। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলায় যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়, তাতে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে… সার্বভৌম জনগণের প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার করা হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ১৯৭২ এর সংবিধানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সকল মানবাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। এই সংবিধানের প্রস্তাবনায় আছে, ‘রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক মানবাধিকার, সাম্য, সুবিচার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে’। এই সংবিধান জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকারের সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যই ছিল সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা। ১৯৭২ সালের ২৫মার্চ স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে মানুষে মানুষে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে।’
দেখা যাচ্ছে দেশ স্বাধীনের পর জনগণের মানবাধিকারের বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হত। বর্তমানে এ অধিকার লঙ্ঘনের নানা নজির আমাদের চোখে পড়ে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার লক্ষ্যে আইনের ব্যবহারসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা ঘটনা অব্যাহত রয়েছে বাংলাদেশে। দেশে মানবাধিকারের লঙ্ঘনের ফলে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের উল্লখযোগ্য কারণ হচ্ছে হত্যা, গুম, খুন, রাহাজানি, সন্ত্রাস, জঙ্গিহামলা, রাজনৈতিক হত্যা, থানা হেফাজতে হত্যা, শিশু ও নারী নির্যাতন, মানব পাচার, অপহরণ, ধর্ষণ, শিশু শ্রম, বাল্যবিবাহ এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক কর্মকান্ডসহ আরও অনেক কিছু।
২০২০ সালের অক্সফামের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বের ২৬ জন ধনী ব্যক্তির কাছে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তা পৃথিবীর সব গরীব লোকের অর্ধেকের সমান। অর্থাৎ মাত্র ২৬ জন মানুষের হাতে ৩৮০ কোটি মানুষের সমান সম্পদ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের প্রায় ২৮ শতাংশের (এক-তৃতীয়াংশের মালিক) মালিক। শীর্ষ ১০ শতাংশ ব্যক্তির আয়ের ভাগ প্রায় ৩৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৮.১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পক্ষান্তরে সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের মাত্র ০.২৩ শতাংশের মালিক। মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রাখতে উদার ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা স্বাধীনতার প্রধান শর্ত। বাংলাদেশ সব সময় মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি মেনে চলার অঙ্গীকার করলেও এই দিবস পালনে যতটা থাকে আনুষ্ঠানিকতা তার সামান্যতম অংশও বাস্তবায়িত হলে বিশ্ব থেকে নির্বাসিত হত বিচার বহির্ভূত হত্যা, শিশু ও নারী নির্যাতন, সন্ত্রাস, ছিনতাই, রাহাজানিসহ হাজারো অপরাধ।
মানবাধিকারের সংবিধান খ্যাত ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা’ মানবাধিকারের বিষয়ে নীতিমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে বলেছে। এগুলো হলো-
শ্রদ্ধা : সরকার মানবাধিকারের বিষয়গুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে;
সুরক্ষা : সরকারকে মানবাধিকারের বিষয়গুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে;
নিশ্চিতকরণ : মানবাধিকার নিশ্চিতকরণে সরকারকে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এই তিনটি বিষয় হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কৌশল বা উপায় যার মাধ্যমে কোনো রাষ্ট্রে মানবাধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় জীবনে মানবাধিকার নিশ্চিত করা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারের প্রধান দায়িত্ব। বাংলাদেশ সরকার এসব বিষয়ে যথেষ্ঠ তৎপর। ইতোমধ্যে সরকার মানবাধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়া দেশে কর্মরত বেসরকারি সংস্থাগুলো সর্বস্তরের মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করে চলেছে।
মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার একে অপরের পরিপূরক। যদি আমরা মানবাধিকারকে তালা কল্পনা করি তাহলে সামাজিক ন্যায়বিচার হচ্ছে চাবি। সমাজের মানুষের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করি তাহলে প্রথমেই দরকার মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার। তালা খুলতে যেমন চাবি প্রয়োজন তেমনি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সামাজিক ন্যায়বিচারের কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্রচিন্তাবিদ লাস্কি বলেন, “গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। গনতন্ত্রই পারে মানুষের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে। আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলেই মানুষের অধিকার সংরক্ষিত হবে। আবার গণতন্ত্রকে সফল করে তুলতে হলে মানুষের সমান অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে।”
লেখক : সমাজ গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।
সহায়ক তথ্যপঞ্জি
১. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী‘, দৈনিক ভোরের কাগজ (ঢাকা), ৪ ডিসেম্বর ২০২২
২. মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, ‘আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার‘, দৈনিক জনকণ্ঠ (ঢাকা), ২৮ জানুয়ারি ২০২২
৩. সৈয়দ আবুল মকসুদ, ‘সততা, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার‘, দৈনিক প্রথমআলো (ঢাকা), ৩১শে মার্চ ২০১৫
৪. সূত্রধর, বাবুল চন্দ্র, ‘মানবাধিকার ও স্থানীয় সরকার’, সমাজ নিরীক্ষণ, সংখ্যা, ১২৮, ২০১৪
৫. জহির রায়হান, ‘সাম্য ও মানবিক মর্যাদার স্বপ্ন কত দূর?‘ দৈনিক প্রথমআলো (ঢাকা), ২৭ এপ্রিল ২০১৯
৬. বিশ্বের ১৫৯ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ২০১৮ সালে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
৭. আকবর আলি খান, অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি, ঢাকা: প্রথমা, ডিসেম্বর ২০২০
৮. মমতাজ লতিফ.‘মানবাধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘন‘, দৈনিক জনকণ্ঠ (ঢাকা), ২৪ আগস্ট ২০২২
৯. তানিয়া সুলতানা, ‘সামাজিক ন্যায়বিচারের চিত্র‘, দৈনিক সমকাল (ঢাকা), ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১
১০. তানিয়া সুলতানা, ‘সামাজিক ন্যায়বিচারের চিত্র‘, দৈনিক সমকাল (ঢাকা), ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১
১১. আইন ও শালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন-২০২১
১২. মো: আরিফুল ইসলাম, ‘মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত‘, সমাজ চিন্তন, ১ম বর্ষ: সংখ্যা ০১, জুন ২০২১
১৩. মিয়া মুহম্মদ সেলিম, সামাজিক উন্নয়ন কৌশল, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, জুন ২০০৯
১৪. মো: আরিফুল ইসলাম, ‘মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত‘, সমাজ চিন্তন, ১ম বর্ষ: সংখ্যা ০১, জুন ২০২১
খুলনা গেজেট/ এসজেড