মাহে সফর চন্দ্র মাসের দ্বিতীয় মাস। ‘সফর’ শব্দটির আবিধানিক অর্থ ‘খালি’। এমাসের পূর্বের মাস মুহররম যুদ্ধ সংঘাত নিষিদ্ধ ছিল বলেই প্রাক ইসলামী যুগে এ মাসে আরবের মানুষ বাড়ীঘর খালি ফেলে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ত বলেই এ মাসকে বলা হয় সফর।
দুনিয়ার মধ্যে যত ধরনের বিপদ আপদ এই মাসে সংগঠিত হয়েছে আর অন্য কোন মাসে হয়নি এবং ভবিষ্যতেও এমাসে অধিক বিপদ মানুষের নিকট অবতীর্ণ হবে। পুরো বছর দশ লক্ষ আশি হাজার সংগঠিত বিপদের নয় লক্ষ বিশ হাজার এ মাসেই নাজিল হয়।
প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বার মাসে যত ধরনের বিপদ আপদ অবতীর্ণ হয় সব ধরনের বিপদ এ মাসের মধ্যে রয়েছে। আল্লাহ পাক জাল্লে শানহু সারা বছর যত বালা মসিবত প্রদান করে থাকেন তম্মধ্যে ৯০ ভাগ এই মাসে, অবশিষ্ট ১০ ভাগ সারা বছর প্রদান করে থাকেন। তাই সফর মাসকে ‘মাহে নুযুলে বালা’ বা বালা মসিবত অবতীর্ণ হওয়ার মাস বলা হয়।
অন্য এক হাদিসে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন, কেউ যদি সফর মাস অতিবাহিত হওয়ার সু-সংবাদ প্রদান করেন আমি তাঁকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করবো।
আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ.)’র পদঙ্খলন হয় এ মাসে। ১ সফর হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। হযরত আইয়ুব (আ.) এ মাসে বিপদে পতিত হন। হযরত আকরাম (আ.), হযরত ইফনুস (আ.) হযরত জরজিস (আ.), হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ.) ও হযরত যাকিবিয়া (আ.) এ মাসে বিপদে পতিত হন। এ মাসে শহীদ হন হযরত হাবিল (আ.)।
মুসলমানদের নিকট আখেরী চাহার শোম্বা একটি ঐতিহাসিক স্মরণীয় দিন। ফারসী ভাষায় হিজরী সালের সফর মাসের শেষ বুধবারকে বলা হয় ‘আখেরী চাহার শোম্বা’। এই দিনে মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১৩ দিন রোগ ভোগের পর শেষ বারের মতো রোগ হতে মুক্তি লাভ করে পবিত্র গোসল করেন। রোগ মুক্তির পর তিনি স্বস্তি পেয়ে ভালোভাবে আহার এবং তাঁর নাতিকে আদর করেন। এরপর তিনি জীবনে আর গোসল করেননি। অতঃপর তাঁর রোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে, ফলে পাঁচ দিন পর মাহে রবিউল আউয়ালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
একাদশ হিজরীর সফর মাসে প্রিয় নবী মাহবুবে খোদা হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন জান্নাতুল বাকির কবর জেয়ারত করেন এবং তাঁর পরের দিন এক সাহাবীর জানাজা নামাজ শেষে বাড়ী ফেরার পথে মাথা ব্যাথার মধ্যদিয়ে তাঁর রোগের সূচনা হয়। এ মাসের সোমবার পর্যন্ত হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোগ বৃদ্ধি পেল। ভীষণ রোগ যন্ত্রণায় তিনি ১৩ তিন অতিবাহিত করার পর তাঁর জীবনের শেষ সফরের শেষ বুধবার রোগ হতে সুস্থবোধ করেন। এ সুস্থতার সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আনন্দের জোয়ার বয়ে যায় মদিনার অলিগলিতে। এরপর তিনি মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লেন এবং উহুদের যুদ্ধের শহীদদের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে যদি কোন ব্যক্তি আমার আচরণে কষ্ট পেয়ে থাকো এখনই তার প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পার। যদি ঋণ পাও তা নিয়ে নাও’। সমবেত সকলেই একবাক্যে বললেন, আপনার নিকট আমাদের কোন প্রাপ্য নেই। মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে তিনি জীবনের শেষ উপদেশগুলো প্রদান করে নিজের বাড়ীতে প্রবেশ করার সময় তাঁর রোগ যন্ত্রণা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবেই পাঁচ দিন অতিবাহিত করে তিনি এ জগতের মায়া ত্যাগ করেন পর জগতে চলে যান।
মুসলমানগণ প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোগ মুক্তির দিবস ‘আখেরী চাহার শোম্বা’ মর্যাদার সাথে পালন করেন। এদিনের খুশিতে আত্মহারা হয়ে শোকারানা নামাজ আদায় ও গরিব মিসকিনদের নিকট অর্থ সাহায্য প্রদান করেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় নবী-রাসুল ও বান্দাদের বিপদ আপদ প্রদান করে পরীক্ষা করে থাকেন। পরীক্ষায় ধৈর্য্য ধারণ করে উত্তীর্ণ হতে পারলেই আরও প্রিয় হন তাঁর। বিপদে কারো সাহায্য নয়, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উসিলায়, কামিল বান্দাদের শিখানো দোয়া, অজিফা ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনাই পবিত্র ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে।
সাহাবায়ে ক্বেরামের সুন্নাত অনুসারে এখনো জাঁকজমকের সাথে প্রতিবছর পালিত হয় আখেরী চাহার শোম্বা।
আখেরী চাহার শোম্বার চেতনা নিয়ে আজকের মুসলমানদেরকে ঈমানী দুর্বলতা থেকে সুস্থতা অর্জন করতে হবে। আনুষ্ঠানিকতায় মত্ত না হয়ে রুহানী ঈমানী চেতনা নিয়ে মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করে সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় দায়িত্ব পালন করতে পারলেই আমাদের আখেরী চাহার শোম্বা সার্থক হবে।
এই মাসের আমল : সফর মাসের প্রথম দিন এশার নামাজের পর চার রাকাত নফল নামাজ আদায় করা উত্তম। এ নামাজের প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহার পর পনের বার সূরা কাফিরুল, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ইখিলাস পরেন বার, তৃতীয় রাকাতে সূরা ফালাক পনের বার এবং চতুর্থ রাকাতে সূরা নসর পনের বার পড়বে। নামাজের পর ‘ইয়াকা না’বুদু ওয়া ইয়াকা নাস্তাইন’ পড়ে সত্তরবার দরুদ পাঠ করবে। এ নামাজ আদায়কারীকে আল্লাহ পাক সকল বিপদ আপদ হতে নিরাপদ রাখবেন।
সফর মাসের শেষ বুধবার গোসল করে চাশতের পূর্বাহ্নে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করবে। এই নামাজের প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর এগার বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে। নামাজ শেষে দরুদ শরীফ পড়বে। এ সকল ইবাদতের উসিলায় আল্লাহ পাক অন্তর ও শরীরকে সুস্থ করে দিবেন।