সাতক্ষীরায় জমি দখলের উদ্দেশ্যে শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের ধুমঘাট অন্তাখালী গ্রামের আদিবাসী মুন্ডা পল্লীতে সন্ত্রাসী হামলায় নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা নিহত হওয়া পর মুন্ডাপল্লীর পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। সন্ত্রাসী হামলার সাথে জড়িতদের অব্যাহত হুমকি ধমকীতে গোটা মুন্ডা পল্লীজুড়ে চাপা আতংক বিরাজ করছে। ফলে মুন্ডা পল্লীতে বসবাসরতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গত শনিবার (২০ আগস্ট) রাত থেকে সেখানে পুলিশি প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এদিকে ধুমঘাট অন্তাখালী মুন্ডাপল্লীতে বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলায় নিহত নরেন্দ্রনাথ মুন্ডার বাড়ি পরিদর্শন করেছেন সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য ওয়াকার্স পার্টি নেতা এড: মুস্তফা লুৎফুল্লাহ। রোববার (২১ আগস্ট) বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে শ্যামনগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী ওয়াহিদ মুর্শেদকে সাথে নিয়ে তিনি মুন্ডা পল্লীতে নিহত নরেন্দ্র মুন্ডার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে নিহতের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেন এবং তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। এসময় তিনি বর্বরোচিত এ হামলার ঘটনার সুষ্ঠ বিচার দাবি করেন। এর আগে তিনি সামেক হাসপাতালে মৃত নরেন্দ্রনাথ মুন্ডার মরদেহ দেখতে যান।
অপরদিকে সন্ত্রাসীদের নারকীয় তান্ডবের পর দু’দিন অতিবাহিত হলেও উপজেলার ধুমঘাট অন্তাখালী মুন্ডা পল্লীর পরিস্থিতি অদ্যাবধি স্বাভাবিক হয়নি। হামলার সাথে জড়িতদের অব্যাহত হুমকি-ধামকিতে গোটা মুন্ডা পল্লীজুড়ে চাপা আতংক বিরাজ করছে। বিশেষ করে স্কুল কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ বাজারে যাওয়া মুন্ডা পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে তারা চরমভাবে উদ্বিগ্ন। ফলে এ জনপদে বসবাসরত মুন্ডাদের মধ্যে চরম ভীতিকর অবস্থার তৈরী হয়েছে।
এদিকে পুলিশ সুত্রে জানা যায়, হামলার ঘটনায় জড়িত এজাহার নামীয় আরও দুই আসামি সন্ত্রাসী হামলার মাষ্টারমাইন্ড রাশিদুল ইসলাম ও আক্কাজ আলী আব্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার পরপরই নুর হোসেন ও নুর মোহাম্মদ নামের দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে আলোচিত এ হত্যা মামলায় দু’দিনে চারজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া মুন্ডাপল্লীতে বসবাসরতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শনিবার (২০ আগস্ট) রাত থেকে সেখানে পুলিশি প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
হামলার শিকার অধির মুন্ডা জানান, শুক্রবার হামলার পর থেকে সন্ত্রাসীরা বিভিন্নভাবে তাদেরকে হুমকি-ধামকি অব্যাহত রেখেছে। বিশেষ করে মামলা দায়েরসহ সংবাদকর্মীরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর ক্ষুব্ধ হয়ে তারা অপরিচিত নম্বরের মোবাইল দিয়ে আমাদেরকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এসময় তারা পাতড়াখোলা ও মানিকখালী স্কুলে অধ্যায়নরত তাদের মুন্ডা পল্লীর বাচ্চাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে না দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। যার প্রেক্ষিতে দৈনন্দিন প্রয়োজনে বংশীপুর বাসস্ট্যান্ডসহ বাজারে যেতে তারা ভয় পাচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
নিহত নরেন্দ্র মুন্ডার নাতি সনাতন মুন্ডা জানান, প্রশাসন পাশে থাকায় এ মুহুর্তে তারা কিছুটা ভরসা পাচ্ছে। তবে পরিস্থিতি শান্ত হলে এবং পুলিশি প্রহরা উঠিয়ে নেয়া হলে তাদের অবস্থা আগের থেকে খারাপ হওয়ার শংকা করছেন তারা।
তিনি জানান, লঠিয়াল বাহিনীর হামলায় শুক্রবার আহত হয়ে মৃত্যুবরণকারী নরেন্দ্র মুন্ডার মৃতদেহ রোববার (২১ আগস্ট) সন্ধ্যায় ধুমঘাট অন্তখালী মুন্ডা পল্লীতে পৌছায়। এর আগে সাতক্ষীরায় তার মৃতদেহের ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন আদিবাসী মুন্ডা অভিযোগ করে বলেন, ওই জমি তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে বলেও স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী হুমকি দিচ্ছেন।
এসব বিষয়ে শ্যামনগর থানার ওসি (তদন্ত) সানোয়ার হোসেন জানান, আদিবাসী মুন্ডাপল্লীতে সন্ত্রাসী হামলার সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তারে মাঠে রয়েছে পুলিশ। ইতিমধ্যে হামলার মূল হোতাসহ চারজনতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে অন্যান্য সব অপরাধীকে আইনের আওতায় নেয়া হবে। সন্ত্রাসী হামলার শিকার মুন্ডা পরিবারগুলোর নিরাপত্তায় পুলিশ সতর্ক রয়েছে বলে জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে জমি দখলের উদ্দেশ্যে শ্রীফলকাটি গ্রামের আবদুল গফুর সরদারের ছেলে রাশিদুল ইসলাম ও এবাদুল হোসেনের নেতৃত্বে দুই শতাধিক লাঠিয়াল শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাট অন্তাখালী গ্রামের মুন্ডা পল্লীর আদিবাসী মুন্ডাদের ওপর বর্বোরচিত হামলা চালায়। বিরোধপূর্ণ ৮ বিঘা জমি দখলে নিতে পূর্বপরিকল্পিত এই তান্ডব চালানোর জন্য বংশীপুর, ঈশ্বরীপুরসহ উপজেলার বিভিন্ন অংশ হতে লাঠিয়ালদের ভাড়া করে আনেন সংশ্লিষ্টরা। এসময় হামলার সাথে জড়িতরা আদিবাসী মুন্ডাদের পরিবারের সদস্যদের অবরুদ্ধ করে রেখে তাদের ভোগ দখলে থাকা জমি চাষ করে সীমানা পিলার স্থাপন করে। একপর্যায়ে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে ককেজন পালিয়ে গিয়ে জমি দখলে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলে মুন্ডা সম্প্রদায়ের লোকজনকে বেপরোয়া লাঠিপেটা করে ভাড়াটিয়া লাঠিয়ালরা। এতে আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ের বিলাসী মুন্ডা, রিনা মুন্ডা, সুলতা মুন্ডা ও নরেন্দ্র নাথ মুন্ডা মারাত্মক আহত হন। এসময় হামলার শিকার পরিবারগুলো ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে সাহায্য চাইলে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের উদ্ধার করে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে। পরে অবস্থার অবনতি হলে নরেন্দ্রনাথ মুন্ডাকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার গত (২০ আগস্ট) বেলা ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা মারা যায়।
খুলনা গেজেট/এমএনএস