খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ পৌষ, ১৪৩১ | ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  গাজীপুরে কারখানায় আগুন : নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২
  হাইকোর্টের বেশ কয়েকজন বিচারপতির বিরুদ্ধে অনিয়ম তদন্তে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন
  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৬৫

শেষ সময়ে পাশে বসার স্মৃতি

শরিফুজ্জামান পিন্টু

প্রথম যেদিন মিজান ভাইয়ের পাশে বসলাম, কতরকম প্রশ্ন তাঁর। মনে হচ্ছিল একটি শিশুর পাশে বসেছি। কত বিচারক, আইনজীবী তাঁকে সমীহ করেন। কিন্তু এতো সহজ, সরল কথা সেই মানুষটি কীভাবে বলেন! সোহরাব ভাই মানে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসানসহ অন্যরা বুঝছিলেন ওনার একের পর এক প্রশ্নে আমি বিব্রত হচ্ছি। কিন্তু এও জানি বাংলাদেশে সাক্ষাৎকার নেওয়ার ক্ষেত্রে এবং পেটের কথা বের করে আনতে প্রয়াত মিজানুর রহমান খানের জুড়ি ছিল না। প্রশ্ন করা এবং যুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন মানুষ সাংবাদিকতা পেশায় খুব কম আছেন।

ওনার প্রথম প্রশ্ন ছিল-আচ্ছা, পিন্টু ভাই রিপোর্টিং বিভাগ থেকে সম্পাদকীয় বিভাগে এসে কেমন লাগছে আপনার? বললাম, ভালোই। আপনাদের মতো বুদ্ধিজীবীদের কাছাকাছি এলাম। হো হো করে হাসি দিলেন তিনি।

এরপর আবার প্রশ্ন-হেড অব রিপোর্টিং থেকে সহকারি সম্পাদক হয়ে কেমন লাগছে? বললাম, খুবই ভালো। সম্পাদকীয় বিভাগকে তো আমরা ‘গার্ডেন’ বলে মজা করি। এখানে নাকি কাজকর্ম কম, জ্ঞানের আলোচনা বেশি হয়। অফিসের অন্য বিভাগে শুধু চা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে, আপনাদের এখানে তো ফ্রি কফি খাওয়ারও ব্যবস্থা রেখেছেন সম্পাদক। বুদ্ধিজীবীর মতো ওনার জবাব-‘তা বটে’।

এবারের প্রশ্ন-আপনি কি নিজের ইচ্ছায় সম্পাদকীয় বিভাগে এলেন, না অফিসের সিদ্ধান্ত? পাল্টা প্রশ্ন করলাম-আপনার কী মনে হয়?’

পাশেই সোহরাব ভাই, চোখের ইশারায় মিজান ভাইকে থামাতে চাইলেন। কিন্তু মিজান ভাই কী এসব মানেন? এরপর সোহরাব ভাই বললেন, ‘মিজান ভাই, আজকেই পিন্টু আমাদের বিভাগে যোগ দিয়েছে। পরে আরও জানতে পারবেন।’

তখন মিজান ভাই বললেন, এ বিষয়ে আর একটি শেষ প্রশ্ন করব। সত্যি করে বলেন, এই বিভাগে এলেন কেন? বললাম, কারণটা খুঁজে নেন ভাই। আপনি তো শুধু কলামিষ্ট না, অনুসন্ধানী রিপোর্টারও।

এরপর থেকে গত অক্টোবর ও নভেম্বরে মাস দুয়েক মিজান ভাইয়ের ঠিক পাশের চেয়ারে বসে কাজ করেছি। গত ২৫ নভেম্বর প্রথম আলো থেকে পদত্যাগ করি, ২৭ নভেম্বর উনি কোভিড আক্রান্ত হন। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আমিও কোভিড আক্রান্ত হই। মসিউর রহমান খানের কাছে ওনার খোঁজ নিতাম। মসিউর ওনার ছোট ভাই, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক। মিজান ভাইয়ের আরেক ভাই সিদ্দিকুর রহমান খানও সাংবাদিক। তাঁরা তিন ভাই কোনও না কোনওভাবে ঘনিষ্ঠ। মসিউর ও সিদ্দিক ছোট ভাইয়ের মতো, কিন্তু মিজান ভাই ওদেরও বড় ভাই, সেই সূত্রে আমারও। পেশাগতভাবেও ওনার অবস্থানও অনেক উর্ধ্বে। ঈর্ষণীয় অনেক ভালো ও বড় কাজ করেছেন তিনি।

অফিসে মিজান ভাইয়ের একপাশে বসতেন এ কে এম জাকারিয়া ভাই, আরেক পাশে আমি। ওনার সামনে মুখোমুখি বসতেন ফারুক ওয়াসিফ, সামনে আরেকদিকে মশিউল আলম। আমার একপাশে ছিলেন সারফুদ্দিন আহমেদ, সামনের দিকে সোহরাব হাসান। এই বিখ্যাত সব লেখকদের ভিড়ে আমি একমাত্র রিপোর্টার।

স্মৃতি : ০১
একদিন শুনতে পাই মিজান ভাই কার কাছে যেন নালিশের সুরে কিছু বলছেন। বিষয় হলো কোভিডের কারণে ওনার এক সন্তানের বেতন দিতে দেরি হয়েছে। বেতন দিতে চাইলেও প্রক্রিয়াগত কোনও ত্রুটির কারণে দিতে পারেননি। এখন জরিমানা যা হয়েছে তা বেতনের প্রায় সমান। পরপর দুদিন শুনলাম উনি বিষয়টি নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। আমি যেচে বললাম, আচ্ছা মিজান ভাই, আমাকে একটু বলেনতো কী হয়েছে?

উনি বললেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের কথা। আমি ওনাকে একজন পদস্থ কর্মকর্তার নম্বর দিলাম।

মিজান ভাইয়ের সরল জবাব, আচ্ছা, উনি আমাকে চিনবেন? বললাম, ‘অবশ্যই চিনবেন’। মিজান ভাই তখনও আমাকে ফোন দিতে বলছিলেন। বললাম, ‘আমি তো আপনার পাশেই আছি। প্রয়োজনে কথা বলব।’

ফোনটি রেখে বললেন, ‘হয়ে গেল পিন্টু ভাই। একটি ফোন নম্বরে এতোবড় কাজ হলো।’ মুখে তাঁর তৃপ্তির হাসি। বললাম, মিজান ভাই আপনি কতটা জনপ্রিয় তা নিজেও জানেন না।

স্মৃতি : ০২
বার্তা সম্পাদক থাকার সময় প্রথম আলোর প্রভিডেন্ড ফান্ড (ভবিষ্য তহবিল) পরিচালনা কমিটির একজন সদস্য ছিলাম। সম্পাদক কেন যেন খুঁজে দেখতে বললেন, কে সবচেয়ে বেশি প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে লোন নেয়। হিসাব বিভাগ বের করল দুটি নাম, আর শীর্ষে মিজান ভাই। বেশ পরে একদিন কথায় কথায় মিজান ভাইকে বললাম, আপনি তো শীর্ষ ঋণ গ্রহণকারী ‘দরবেশ’ বাবা। হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি।

মিজান ভাইয়ের কাজ দেখে মাঝেমধ্যে আমরা হাসতাম। হঠাৎ ওনার মাথায় আসল, বিনোদন ছুটির টাকা পাননি। এইচআর, অ্যাকাউন্টস বিভাগে যোগাযোগ করলেন। তাঁরা জানালেন, এটা আপাতত বন্ধ আছে। মিজান ভাই কী আর এটুকু শুনে সন্তুষ্ট হবেন। তিনি একটি চিঠি লিখলেন সম্পাদককে। আমরা তো ভয়ে অস্থির। অফিসে বিশেষ সময় যাচ্ছে। ছাঁটাই চলছে, বেতন কর্তন হচ্ছে। এর মধ্যে বিনোদন ছুটির টাকা চেয়ে সম্পাদকের কাছে সরাসরি চিঠি নিয়ে যাবেন মিজান ভাই। সহকর্মীদের কে যেন একজন বললেন, ‘শোনেন মিজান ভাই, সেই মতি ভাই এবং এখনকার মতি ভাই কিন্তু আলাদা মানুষ।’ কিন্তু মিজান ভাই কী কারও কথা শোনা লোক? চিঠি নিয়ে সম্পাদকের কক্ষে হাজির। এরপর সেখানে কী হয়েছে জানি না। ফিরে এসে জানালেন, ‘বিনোদন ছুটির টাকা কিন্তু আমি পাচ্ছি এবং তিনি তা পেয়েছেন।’

নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে মিজান ভাই সম্পাদককে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। পুরো চিঠিটি সম্পাদককে নিয়ে লেখা। তাতে তিনি এখনকার এই সঙ্কটময় ও সমালোচানমূলক পরিস্থিতিতে সম্পাদকের করণীয় সম্পর্কে লিখেছিলেন। সঙ্গত কারণে ওই চিঠির তথ্য উল্লেখ করছি না। সম্পাদকীয় বিভাগের তিন-চারজন মিলে সেই চিঠি শুনেছি। কবিতার মতো করে মিজান ভাই জোরে জোরে পাঠ করেছিলেন সেটি। মেইলে সম্পাদককে চিঠিটি পাঠিয়ে তিনি উচ্ছাস প্রকাশ করলেন। মনের কথা তিনি সম্পাদককে খুলে বলতে পেরেছেন, এতেই তিনি খুশী।

স্মৃতি : ০৩
২০০৯ সালের পর থেকে প্রধান প্রতিবেদক অথবা হেড অব রিপোর্টিংয়ের দায়িত্ব পালন করার সময় মিজান ভাইয়ের হাত থেকে রক্ষারে উপায় ছিলেন প্রধান বার্তা সম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহ্ছি। মিজান ভাই মাঝেমধ্যে সন্ধ্যায় নিউজরুমে ঢুকলে বুঝতাম আজ খবর আছে। উনি যখন রিপোর্ট দেওয়ার কথা, তার এক থেকে দুই ঘন্টা পর দেবেন। এরপর কপি এডিট হলেও তাঁর কাজ শেষ হতো না। তিনি একটি তথ্য, দুটি বাক্য, নামের স্পেলিং—এমনসব কথা বলে ঢুকে পড়তেন সম্পাদনা বিভাগ বা গ্রাফিক্সে।

মিজান ভাই ঢুকে কাউকে যদি বলেন তাঁর লেখা সংশোধন করবেন, এটা ‘না’ বলার ক্ষমতা খুব কম লোকেরই ছিল। এ জন্য গ্রাফিক্স বা সম্পাদনা বিভাগের কর্মীরা গোপনে সহায়তা চাইতেন নিউজ ব্যবস্থাপকদের কাছে। কারণ মিজান ভাই ওদের পাশে বসলে দিনের কাজে বিলম্ব হতো। তাসত্ত্বেও তিনি চাইতেন নিজের লেখার ভুল বা ঘাটতি যেন না থাকে। আসলে তিনি ছিলেন আপাদমস্তক সাংবাদিক। সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করলেও রিপোর্ট করা ছিল তাঁর নেশা।

স্মৃতি : ০৪
প্রায়ই বলতেন, তিনি একটি পুরানো ফ্ল্যাট কিনতে চান। দাম হতে হবে ৭০-৮০ লাখ টাকা। আর সাইজ হতে হবে ১৩০০-১৪০০ বর্গফুট। বললাম, তিন সন্তান নিয়ে থাকবেন কীভাবে? বললেন, হয়ে যাবে। এরপর বললাম, কীভাবে কিনবেন, টাকা রেডি আছে? বললেন, এখন ৩০ লাখ টাকা দেবো। বাকি টাকা আস্তে আস্তে দেব। বললাম, আপনি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ মিটিয়ে কিস্তি দিবেন কীভাবে?

ওনার কাছে জানতে চাইলাম, আপনার কাছে ৩০ লাখ টাকা কি নগদ আছে? নরম গলায় বললেন, মানে অফিস থেকে পাবো। বললাম, অফিস থেকে পাবেন তো তখনই যখন চাকরি ছাড়বেন অথবা অফিস আপনাকে বিদায় দেবে। এসব শুনে মিজান ভাইয়ের হিসাব যেন গোলমাল হয়ে গেলো। ওনার ধারণা ছিল, অফিসে উঁচু পদের অনেকেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাচ্ছেন। ওনার বেলায়ও হয়তো তাই হবে। আর চুক্তিতে গেলে উনি প্রাপ্য বুঝে পাবেন, সেই টাকা দিয়ে ফ্ল্যাটের দামের একটি অংশ শোধ করবেন। কিন্তু সেই ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন তাঁর পূরণ হলো না।

ওনার মতো মানুষের অন্যায় না করেও তো একটি ফ্ল্যাট কেনার সঙ্গতি থাকার কথা। কিন্তু মানুষটি জ্ঞানী ছিলেন, পেশাদার ছিলেন। কিন্তু গোছানো ছিলেন না। অনেক মেধাবীর মধ্যেই এটা থাকে। হয়তো মিজান ভাইও তাই।

স্মৃতি : ০৫
মিজান ভাইয়ের ছোট ভাই মসিউর রহমান ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নির্বাচন করবেন। একদিন মিজান ভাইকে বললাম, ‘আপনি তো আমার কাছে ভোট চাইলেন না ছোট ভাইয়ের জন্য।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘ভোট তো আপনি চাইবেন আমার কাছে।’ বললাম, তা কেন?

ওনার জবাব, ‘আপনি তো মসিউরের মনোনয়নপত্রে সমর্থক হিসেবে সই করেছেন। মসিউর হেরে যাওয়া মানে সমর্থক হিসেবে আপনারও হেরে যাওয়া। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে দেখলাম ছোট ভাইয়ের জন্য তিনি ছোটাছুটি করলেন।
আমার মনে পড়ে সিদ্দিকুর রহমানের গ্রেপ্তার হওয়ার কথা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর কী গভীর উদ্বেগ। ভাইকে মুক্ত করতে সব চেষ্টাই করলেন এবং সফল হলেন।

স্মৃতি : ০৬
মিজান ভাই এবং মশিউল আলম ভাইয়ের ঝগড়া বেশ উপভোগ্য ছিল। তাঁদের কথা কাটাকাটি, ঝগড়া ও বিতর্কের সময় কাজই করা যেত না। মিজান ভাই দ্রুত লিখতেন, বাক্য অনেকসময় শেষ হতো না, কিছু বানান ভুল থাকত। কিন্তু মশিউল ভাই এসব বিষয়ে বেশ খুঁতখুঁতে। এগুলো দেখলেই তিনি খেপে যেতেন।

একদিন মশিউল ভাই বললেন, ‘মিজান ভাই, সারাদিন আপনার কপিই দেখলাম। আমার কি নিজের কোনও কাজ নেই?’
মিজান ভাইয়ের জবাব, ‘আপনি দেখলেন কেন? আমিতো আপনাকে দেখতে বলিনি।’
মশিউল ভাই বললেন, ‘সম্পাদক বা পাঠক তো আর জানবে না যে আপনার এই লেখার পেছনে আমাকে কতটা সময় দিতে হয়েছে।’

মিজান ভাইয়ের জবাব, ‘আপনি তো বিভাগের ডেপুটি, লেখা দেখাই আপনার কাজ।’
মশিউল ভাই বললেন, ‘আমি তো ডেপুটি এডিটরের ডেপুটি।’
মিজান ভাইয়ের জবাব, ‘তাহলে আপনি দেইখেন না আমার কপি। সরাসরি প্রুফে পাঠায়ে দেন।’
এরপর মশিউল ভাই ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘মানুষ তো বলে আপনি অনেক বড় লেখক, তাহলে এতো ভুল থাকবে কেন?’
মিজান ভাইয়ের জবাব, ‘আপনার কোনও কথা থাকলে সম্পাদককে গিয়ে বলেন।’

এভাবে তুমুল ঝগড়া দুই বাঘা লেখকের মধ্যে। পরদিন মশিউল আলম পিঠা নিয়ে আসলেন। আমাদের বাদ দিয়ে সবার আগে মিজান ভাইকে দিলেন।’ মিজান ভাই পিঠা খেয়ে তুমুল প্রশংসা। অথচ ঝগড়ার চব্বিশ ঘন্টাও কিন্তু পার হয়নি। এই হলেন মিজান ভাই, যার মধ্যে অহংকার ছিল না। এমন ঝগড়া যে একদিন হয়েছে তা নয়, মাঝেমধ্যেই হতো। আবার দ্রুত তা মিটে যেত।

স্মৃতি : ০৭
মিজান ভাইকে আমরা বলতাম ‘ছোট মুন্সী’। বিশেষ করে আমি তো বলতামই। সাংবাদিকতা জগতের অনেকেই হয়তো এই নামের রহস্য জানেন। নামটি দিয়েছেন লন্ডন প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। আরেক সহকর্মীকে আমরা ডাকতাম ‘বড় মুন্সী’ বলে, তিনি কবি ও লেখক সোহরাব হাসান। তাঁর এই নামটিও গাফফার ভাইয়ের দেওয়া। উনি তাঁর বিভিন্ন লেখায় প্রথম আলো সম্পাদক মতি ভাইয়ের দুজন মুন্সীর কথা উল্লেখ করতেন। তার মানে হচ্ছে, মতি ভাই যা লিখতে বা বলতে পারতেন না, তা ওই দুজনকে দিয়ে লেখাতেন।

গাফফার ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, মিজান ভাইকে দিয়ে এমন কিছু লেখানো কঠিন ছিল। তাই মজা করে গাফফার ভাইয়ের সুরে সুর মিলিয়ে মিজান ভাইকে ‘ছোট মুন্সী’ বললেও আসলে তিনি তা ছিলেন না। ‘বড় মুন্সী’ সোহরাব হাসানের বেলায়ও এটা সত্য।

আসলে গাফফার ভাইয়ের লেখার ধরনই এ রকম। তিনি কারও নাম না নিলেও এমনভাবে বলতেন যা সাধারণ পাঠক না বুঝলেও যারা বোঝার তারা ঠিকই বুঝতেন। যেমন ইত্তেফাক-আজাদের বিরোধের সময় তিনি লিখতেন, হাটখোলার পত্রিকা বা ঢাকেশ্বরীর পত্রিকা, মতি ভাইয়ের নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘তওবা সম্পাদক’।

স্মৃতি : ০৮
দেড় দশকের সহকর্মী এবং দুই মাস পাশে বসার অভিজ্ঞতা থেকে বলব, তিনি ছিলেন একজন আপাদমস্তক সাংবাদিক। অনেকেই আপাদমস্তক সাংবাদিক হলেও তিনি ছিলেন ২৪ ঘন্টার সাংবাদিক, একজন কাজপাগল মানুষ। উনি ছিলেন বয়সে সিনিয়র, ওনার পদবি যুগ্ম সম্পাদক। কিন্তু চিফ রিপোর্টার বা নিউজ এডিটরের দায়িত্ব পালনের সময় ওনাকে কোনও কাজের কথা বললে ‘না’ শুনিনি। হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের বড় বা জটিল রায় প্রকাশ হলেই ওনাকে খুঁজে বের করতাম। দিনের অসংখ্য কাজের মধ্যে শত শত পৃষ্ঠার রায় পড়ে মর্মার্থ বের করা সম্ভব ছিল না। রিপোর্টারও অনেকসময় কাজের চাপে হিমসিম খেতেন। এমন পরিস্থিতিতে ভরসা ছিলেন মিজান ভাই। কোনও ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়ার ক্ষেত্রে ওনার সমমানের কাউকে আর দেখি না।

অসুস্থ হওয়ার পর মানুষ যে ভালোবাসা তাঁকে দেখিয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। তাঁর জন্য যত মানুষ দোয়া করেছেন, এটা দেখে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েছে। আর তাঁর মারা যাওয়ার পর যে প্রতিক্রিয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গণমাধ্যমে দেখেছি তাতে তাঁর সহকর্মী হিসেবে বুকটা গর্বে ভরে গেছে। দিনশেষে, জীবন শেষে, কর্মক্ষেত্রে এবং সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠার পর মানুষের এই ভালোবাসাই মনে হয় সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই শ্রদ্ধা-ভালোবাসাই সত্য, বাকি সব মিথ্যা।

স্মৃতি : ০৯
প্রথম আলোয় আমার শেষ দুই মাসে পাশাপাশি বসে মিজান ভাই সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা বদলে যায়। ২০০৫ সালের কাছাকাছি সময়ে আমরা যোগ দিয়েছিলাম প্রথম আলোতে। গত ২৫ নভেম্বর আমি প্রথম আলো ছেড়ে দেওয়ার আগে সম্পাদকীয় বিভাগের সবাই মিলে একসঙ্গে লাঞ্চ করতে চেয়েছিলাম। এ কে এম জাকারিয়া ভাই বললেন, মিজান ভাই সুস্থ হলেই একসঙ্গে খাবো। অপেক্ষা করছিলাম উনি সুস্থ হবেন, কারওয়ানবাজারে একটি নতুন খাবার হোটেল হয়েছে, সেখানে লাঞ্চ করব। সেখানেই গত ৩১ অক্টোবর লাঞ্চ করেছিলাম আমরা। সেদিনের হোস্ট ছিলেন মিজান ভাই, উপলক্ষ্য ছিল তাঁর জন্মদিন। সম্পাদকীয় বিভাগের সোহরাব হাসান, এ কে এম জাকারিয়া, মশিউল আলম, ফারুক ওয়াসিফ এবং সারফুদ্দিন আহমেদ যোগ দেন মধ্যাহ্ন ভোজে। বাইরে থেকে সাবেক সহকর্মী হিসেবে যোগ দেন রোকেয়া রহমান, তিনিও মাসকয়েক আগে সম্পাদকীয় বিভাগে ছিলেন।

হোটেলে ঢোকার পর দেখি, সবাই খাওয়া শুরু করেছেন, মিজান ভাই অপেক্ষা করছেন। কারণ তিনি হোস্ট, অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। অন্যদের কাছে অবশ্য আমি আগেই দুঃখ প্রকাশ করে খাবার শুরু করতে অনুরোধ করছিলাম। কারণ আকস্মিক একটি কাজে আটকে যাওয়ায় আমার কিছুটা দেরি হয়েছিল। আমি আসলে খাবার শুরু করলেন মিজান ভাই।

প্রিয় মিজান ভাই, সহকর্মী হিসেবে আপনিসহ অন্যদের কাছ থেকে আমার বিদায় উপলক্ষ্যে মধ্যহ্নভোজটি আর হলো না। আপনি হাসপাতাল থেকে চলে গেলেন মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। আপনাকে ছাড়া আমাদের সেই খাবার কি আর গলার নিচে নামবে? ভালো থাকেন মিজান ভাই, এতো মানুষের ভালোবাসা নিয়ে কারও খারাপ থাকার কথা নয়।

(ফেসবুক টাইমলাইন থেকে সংগৃহিত )

 

খুলনা গেজেট / এআর




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!