খুলনা, বাংলাদেশ | ৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১০৩৪
  যাত্রাবাড়িতে ব্যাটারিচালিত অটো রিকশাচালকদের সড়ক অবরোধ, সংঘর্ষে দুই পুলিশ আহত

শিল্পাঞ্চল ফের অশান্ত, গুলিতে শ্রমিক নিহত ও সহিংসতায় যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা

গেজেট ডেস্ক

পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণার পরও শিল্প এলাকা গাজীপুর ও আশুলিয়া গতকাল বুধবারও ছিল অশান্ত। বেতন কাঠামো প্রত্যাখ্যান করে মজুরি আরও বাড়ানোর দাবিতে গাজীপুরের শ্রমিকরা রাস্তায় নামলে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় ব্যাপক সংঘাত হয়েছে।

এ ঘটনায় এক নারী শ্রমিক নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। এর মধ্যে হঠাৎ সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণে এক পুলিশ সদস্যের হাতের কবজি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

সর্বশেষ বিকেল ৪টার দিকে বিক্ষোভকারীরা ঢাকা-টাঙ্গাইল ও গাজীপুর-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে নাওজোর ও বাসন এলাকার বেশ কয়েকটি কারখানায় ভাঙচুর চালায়। এ সময় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। এতে পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। এতে ৫ পুলিশ আহত হন। ঘটনাস্থলে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। রাত ১০টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রাতে বৈঠকে বসেছে শিল্প পুলিশ।

 

শ্রমিকদের ওপর চালানো সহিংসতায় যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা

এদিকে বৈধ ট্রেড ইউনিয়নকে অপরাধীকরণের বিরুদ্ধে এবং নূন্যতম মজুরির জন্য বাংলাদেশের পোশাক খাতের বিক্ষোভকারী শ্রমিকদের ওপর চালানো সহিংসতায় নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বুধবার এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার।

বিবৃতিতে মিলার বলেন, সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সদস্য ও কারখানা শ্রমিক রাসেল হাওলাদারের (২৬) গত সপ্তাহে পুলিশের হাতে নিহতের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র দুঃখ প্রকাশ করছে। সেই সঙ্গে একটি কারখানায় বিক্ষোভকারীদের আগুনে ইমরান হোসেনের (৩২) মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের পরিবার এবং বৃহত্তর শ্রমিক সম্প্রদায়ের প্রতি আমাদের সমবেদনা জানায়।

মিলার আরও বলেন, শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়নের ওপর চলমান দমন-পীড়ন নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন। শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানাই। সেই সঙ্গে শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা ফৌজদারি অভিযোগের তদন্ত করতে আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আমরা সে সমস্ত বেসরকারিখাতের সদস্যদের প্রশংসা করি, যারা যুক্তিসঙ্গত মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে ইউনিয়নের প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ত্রিপক্ষীয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্তদের ন্যূনতম মজুরির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে, যাতে এটি শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চাপকে কমাতে পারে।

দিনভর যা ঘটেছে

এর আগে সকাল থেকে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে নগরের কোনাবাড়ী, জরুন, বাইমাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করতে থাকে শ্রমিকরা। কোনাবাড়ীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আঞ্জুয়ারা খাতুন (৩০) নামের এক নারী শ্রমিক নিহত হন। তাঁর গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের চর নাটিপাড়ায়।

কোনাবাড়ীতে পরিবার নিয়ে বাস করতেন আঞ্জুয়ারা। কিছুদিন ধরেই মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল শ্রমিকরা। মঙ্গলবার সরকারের মজুরি বোর্ড মালিকপক্ষের প্রস্তাবের সঙ্গে সংগতি রেখে ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেয়। তবে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে বেশ কিছু শ্রমিক সংগঠন।

এদিকে মজুরি বাড়ানোর ঘোষণার পরও সাভারের আশুলিয়ার নরসিংহপুরসহ ওই এলাকার অধিকাংশ কারখানায় শ্রমিকরা গতকাল কর্মবিরতি পালন করে। সকালে শ্রমিকরা কারখানায় গেলেও কাজে অংশ নেয়নি। অনেক কারখানা কর্তৃপক্ষ কাজ করার জন্য বারবার অনুরোধ করলেও বেলা ১১টার দিকে শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে কারখানা থেকে বেরিয়ে যায়। পরে শ্রমিকরা সড়ক অবরোধের চেষ্টা চালায়। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় কয়েকটি কারখানায় ভাঙচুর চালায়। পরে কর্তৃপক্ষ আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ কারখানায় বুধবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে।

কোনাবাড়ী রণক্ষেত্র

গতকাল সকাল থেকে গাজীপুরের কোনাবাড়ী শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা কয়েকটি পয়েন্টে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। এ সময় পুলিশ-শ্রমিকের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। একপর্যায় পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গের চেষ্টা করে। পুলিশের রাবার বুলেটে নারী শ্রমিকসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। পরে রাবার বুলেটবিদ্ধ আঞ্জুয়ারা খাতুন মারা যান।

প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ, শ্রমিক ও স্থানীয়রা জানান, বুধবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ইসলাম গার্মেন্ট, ডিবিএল গ্রুপের কয়েকটি কারখানা, মণ্ডল গ্রুপের শ্রমিকরা কোনাবাড়ী, কাশিমপুর-কোনাবাড়ী আঞ্চলিক সড়কের জরুন এলাকায় অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে। পরে দোকানপাট ভাঙচুর, সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে শ্রমিকরা। একপর্যায়ে পুলিশ ও বিজিবি ঘটনাস্থলে গিয়ে টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। শ্রমিকরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এ সময় বিজিপির কয়েক প্লাটুন সদস্য শ্রমিকদের ধাওয়া দিয়ে আঞ্চলিক সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়। পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেটে অর্ধশতাধিক শ্রমিক আহত হয়। আহতদের মধ্যে নারী শ্রমিক আঞ্জুয়ারা খাতুনের শরীরের বিভিন্ন স্থানে রাবার বুলেট বিদ্ধ হলে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।

আঞ্জুয়ারা খাতুনের স্বামী মো. জামাল হোসেন বলেন, ‘অনেক রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আমার স্ত্রী মারা গেছে। ইসলাম গার্মেন্টে চাকরি করত সে। আমিও আলাদা একটি গার্মেন্টে চাকরি করি। আঞ্জুয়ারা গার্মেন্ট থেকে বের হয়ে চৌরাস্তার জরুন এলাকায় এলে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যায়। আমি এ হত্যার বিচার চাই।’

জরুন এলাকার ব্যবসায়ী নয়ন মিয়া বলেন, কোনাবাড়ী ও কাশিমপুর শিল্পাঞ্চলের শত শত শ্রমিক সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বেতন বাড়ানোর দাবিতে সড়কে অবস্থান নেয়। বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করতে থাকে তারা। পুলিশ-শ্রমিকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হলে আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়।

গাজীপুর মেট্রোপলিটনের কোনাবাড়ী থানার ওসি একেএম আশরাফ উদ্দিন জানান, শ্রমিকরা আঞ্চলিক সড়কগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ) আবু তোরাব মো. সামছুর রহমান বলেন, শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে এলাকায় অতিরিক্ত শিল্প পুলিশ, মহানগর পুলিশ, বিজিবি সদস্য মোতায়েন রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট, জলকামান প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

বিকেলে ফের সংঘর্ষ

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র বলছে, বিকেল ৪টার দিকে হঠাৎ ফের অশান্ত হয়ে ওঠে গাজীপুর। আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের একটি এপিসি কারে বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনায় এক পুলিশ সদস্যের কবজি উড়ে গেছে। আহত হয়েছেন আরও চারজন। বিকেলে কারখানা ছুটি ঘোষণার পর ৪টার পর থেকে নগরের শিববাড়ী, চান্দনা চৌরাস্তা, নাওজোড়, ইটাহাটা ও ভোগড়া এলাকার বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা সরকার ঘোষিত নতুন বেতন কাঠামো প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভ শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা নাওজোড় ও চান্দনা চৌরাস্তায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। এতে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে শ্রমিকরা আশপাশের কারখানায় ঢিল ছুড়ে ভাঙচুর করতে থাকে। এ সময় মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট দেখা দেয়। খবর পেয়ে থানা ও শিল্প পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে পুলিশ, বিজিবি ও র‍্যাবের সমন্বয়ে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। এ সময় শ্রমিকরা পিছু হটে। পরে তারা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। এক পর্যায়ে ভাওয়াল বদলে আলম সরকারি কলেজের সামনের ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে তারা। বিকেল সোয়া ৫টার দিকে পরিস্থিতি শান্ত হতে থাকে। এর পর মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!