খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

শিক্ষকের শিক্ষক : আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি

অধ্যাপক ড. সেলিনা আহমেদ

জগতে একজন শিক্ষক সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব ও সম্মান পান তাঁর শিক্ষার্থীদের কাছে। সময়ের পরিক্রমায় সেই শিক্ষার্থী নিজে শিক্ষক হয়ে উঠলেও পারস্পরিক সম্পর্কের বদল ঘটে না; ঘটা উচিত নয়। বলছিলাম আমার শিক্ষক স্বনামধন্য সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আবদুল কাদির ভূঁইয়ার কথা। আজ তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গেল বছর এই দিনে ঢাকাস্থ নিজ বাসভবনে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। কিন্তু আমার কাছে তিনি ছিলেন শুধুই আমার শিক্ষক, পিতৃতুল্য একজন মানুষ।

১৯৯৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিল শিক্ষার্থী হিসেবে অধ্যাপক ভূঁইয়ার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। তিনি আমার থিসিসের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। পরবর্তীতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে আমি তাঁকে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ রূপে পাই। কিন্তু সেই সম্পর্ক কখনও শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ককে ছাপিয়ে উঠতে পারেনি। কর্মকালেও আমি স্নেহে-শাসনে তাঁর ছাত্রীই রয়ে গিয়েছিলাম। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে টেকনিক্যাল নানা ডিসিপ্লিনের ভিড়ে তিনি সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন। শিক্ষক হিসেবে আমার উপস্থিতিতে এ ডিসিপ্লিনের প্রথম ক্লাসটিও তিনিই নিয়েছিলেন। তারপর ভাল লাগা বশতঃ বেশ কিছুদিন তিনি সকালে ডিসিপ্লিনের ক্লাস নিয়ে যথাসময়েই তাঁর মূল কর্মক্ষেত্র উপাচার্যের অফিসে পৌছুতেন। পরবর্তীতে উপাচার্যের দায়িত্বে ব্যস্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি আর ক্লাস নিতে পারেননি। এজন্য তাঁর মনোঃকষ্ট ছিল। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের পড়াতে তিনি যতটা ভালবাসতেন, অফিসিয়াল দায়িত্বকে তিনি তেমন উপভোগ করতেন না। তবে উভয়ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সময় ও নীতিনিষ্ঠ, যা আজকের দিনে বিরল।

নতুন চালু হওয়া সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান হিসেবে আমি তাঁর থেকে প্রযোজ্য সকল রকমের সহযোগিতা পেয়েছিলাম। কিন্তু সে সহযোগিতা কখনওই অন্য কোন ডিসিপ্লিনকে প্রদত্ত সহযোগিতা থেকে বেশি ছিল না। আমাকে অনেকেই বলতেন তাঁর সাথে ব্যক্তিসম্পর্কের সুযোগ নিয়ে কেন সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনে আরও সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করছি না। যারা বলতেন, তাঁরা অধ্যাপক ভূঁইয়াকে চিনতেন না। নিজের প্রতিষ্ঠিত আগ্রহের জায়গাটিতে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ হিসেবে এমন নিরপেক্ষ থাকতে পারাটা যে কত বড় গুণ তা সেদিন ততটা না বুঝতে পারলেও আজ বেশ বুঝতে পারি। তিনি যখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধপাকা রাস্তা, আজকের মতো এত গাছগাছালিও ছিল না। গ্রীষ্মের কাঠফাঁটা রোদ্দুরে ক্লাস শেষে হলে ফেরার সময় শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে ছাত্রীরা অত্যন্ত কষ্ট পেতো। মনে পড়ে, তাঁর নির্দেশে আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে ডিসিপ্লিনের উদ্যোগেও গাছ লাগিয়েছিলাম। সেইসব গাছ আজ ফুলেফলে শোভিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছায়া দিচ্ছে। পূর্ববর্তী কর্মস্থলে অত্যন্ত শিক্ষার্থীবৎসল শিক্ষক হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক ভূঁইয়ার প্রকৃত পরিচয় থেকে অনেকক্ষেত্রেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বঞ্চিত হয়েছে তিনি প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বে থাকার কারণে। বলতে দ্বিধা নেই ভাল শিক্ষক হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক ভূঁইয়ার শিক্ষার্থী হিসেবে আমি তাঁর থেকে যতটুকু পেয়েছি শিক্ষক হিসেবে আমার শিক্ষার্থীদের এখনও ততটুকু দিতে পারিনি বলেই আমার বিশ্বাস।

মানুষ হিসেবে অত্যন্ত সৎ ও পরোপকারী অধ্যাপক ভূঁইয়ার একটিই দূর্বলতা ছিল, সে হল তাঁর রাগ। নিয়ন্ত্রণহীন এই রাগের কারণেই তাঁর অনেক সৎ ও যুক্তিযুক্ত কাজ যথার্থ মূল্যায়ন পায়নি। অনেক কাছেরজনও সময়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তিনি বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে কারও থেকেই কখনও মুখ ফিরিয়ে নেননি। তাঁর রাগের আয়ু ছিল বড়জোর একবেলা। যার উপর রাগ করতেন, কিছু সময় পর তাকেই ডেকে সামনে বসিয়ে চা খাওয়াতেন। মানুষকে সাহায্য করে তিনি আনন্দ পেতেন। অপরিচিত মানুষও তাঁর কাছে সাহায্যের জন্য গেলে তিনি সাধ্যমত করেছেন। নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়েও অর্থবান বন্ধুবান্ধব ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের থেকে সহায়তা নিয়ে তিনি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতেন। অবসরগ্রহণের পর তাঁর এ ধরনের কাজে অনেকেই বিরক্ত হতেন, তিনি যে তা বুঝতেন না তাও নয়; তবু শিক্ষার্থীদের সহায়তায় তিনি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন।

একজন প্রথিতযশা সমাজবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ হিসেবে অধ্যাপক ভূঁইয়ার অবদানকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। আজকের যুগে তাঁর মত শিক্ষার্থীবান্ধব, ন্যায়নিষ্ঠ, মানবিক ও স্বজনপ্রীতির উর্দ্ধে থাকা মানুষের খুব প্রয়োজন।

আজ তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আবদুল কাদির ভূঁইয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বাদ আসর এক দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। তাঁর সহকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী ও পরিচিত সকলকে স্ব স্ব অবস্থানে থেকে তাঁর আত্মার মাগফেরত কামনায় দোয়া প্রার্থনা করছি। আমীন।

(লেখক : শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)

খুলনা গেজেট/কেএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!