সারাদেশে তখন সর্বহারা পার্টি ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির দৌরাত্ম। পুলিশ বাহিনী রেড এলার্ট জারি করলো। কোন কিছুতে কাজ হলো না। পুঁজিবাদ নিধনের নামে শুরু হলো খুন, জখম, চাঁদাবাজি, লুটপাট ইত্যাদি। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শক্তিশালী করতে ও দলীয় কোন্দলে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির প্রচুর অস্ত্র গোলাবারুদ প্রয়োজন ছিল। তাই তারা পুলিশ ও আনসার বাহিনীকে টার্গেট করে অস্ত্র গোলাবারুদ লুটের নেশায় মেতে উঠে।
হঠাৎ একরাতে বরিশাল শিকারপুর ফেরিঘাটে আনসার বাহিনীর রাইফেল ও গুলি লুট হয়ে গেল। একজন আনসার সদস্য নিহত হলেন। আমি তখন বরিশাল কোতোয়ালি থানায় শিক্ষানবিশ এসআই হিসেবে কর্মরত। শিকারপুর ফেরিঘাট কোতোয়ালি থানার অন্তর্ভুক্ত না হলেও বরিশাল জেলার আওতাধীন হওয়ায় সারা জেলায় পুলিশের রেড এলার্ট আরও জোরদার হলো। এমনিতেই পুলিশের চাকরিতে সবসময় ব্যস্ত জীবন যাপন করতে হয়, তারপর এমন পরিস্থিতিতে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
তখন বরিশালের এসপি ছিলেন জনাব খন্দকার সাহেব আলী সাহেব। তাঁর টকটকে সুন্দর চেহারা কয়েকদিনের মধ্যে মলিন হয়ে উঠলো। সকল পুলিশের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ, রাতের ঘুম হারাম হয়ে পড়লো। শুরু হলো রাত দিন অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার অভিযান। বেশি-বেশি টার্গেট করা হলো বাবুগঞ্জ ও উজিরপুর থানা এলাকা। পার্শ্ববর্তী ঝালকাঠি জেলার কিছু অংশ সন্দেহের তালিকায় রেখে সাঁড়াশি অভিযান চলতে থাকলো। নদ -নদী, খালে ভরা বরিশালের দুর্গম এলাকায় চিরুনি অভিযানের ফলে বেশকিছু সন্দেহভাজন আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির সদস্য ধরা পড়লো। কিন্তু শিকারপুর ফেটিঘাটে আনসার বাহিনীর লুট হওয়া রাইফেল উদ্ধার করা গেল না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, পুলিশের আইজি, ডিআইজি বরিশাল জেলা সফর করে এসপি সাহেবের ওপর রীতিমতো চাপ সৃষ্টি শুরু করতে থাকলেন। সন্দেহভাজন কয়েকজন আসামিকে ডিটেনশনে রাখা হলো। কিন্তু আসল কাজটি অর্থাৎ লুট হওয়া রাইফেল উদ্ধার করা গেল না।
হঠাৎ একদিন আমার কাছে গোপনে খবর এলো জেলে থাকা সন্দেহভাজন আসামি আলতাফ (ছদ্মনাম দিলাম) কে রিমান্ডে নিয়ে টর্চার করলে আনসার বাহিনীর লুট হওয়া রাইফেল পাওয়া যেতে পারে। বিষয়টি শোনার পর বেশ রোমাঞ্চকর মনে হলো। এর আগে আলতাফকে পুলিশ রিমান্ডে অমানবিক নির্যাতনের কথা আমার মনে পড়ে গেল। অস্ত্র লুটের ঘটনায় মূল সন্দেহের তালিকায় ছিল এই আলতাফ। আমার সামনে তাকে সকল প্রকার পুলিশি নির্যাতন করা হয়েছিল। তার অসহায় অবস্থা দেখে আমার খুব মায়া লাগতো। তাই মাঝে-মাঝে সুযোগ পেলে তাকে একটু সান্ত্বনা দিতাম৷ সেই সুবাদে আমাকে সে মনে-মনে একটুআধটু বিশ্বাস করতে শুরু করে। কিন্তু আমি শিক্ষানবিশ অফিসার হওয়ায় এতবড় সন্দেহভাজন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অধিকার আমার ছিল না। শুধু মাঝে-মাঝে চুপিচুপি একটু সেবা করেই খুশি থাকতে হতো। আসামি আলতাফের মা প্রায় প্রতিদিন থানার বাইরে খাবার নিয়ে বসে থাকতেন। থানার সেন্ট্রি বা অন্য কোন মাধ্যমে যোগাযোগ করে কোনদিন খাবার খাওয়াতে পারতেন, আবার কোনদিন রান্না করা খাবার নিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে যেতেন। আমি এসব কিছুই জানতাম না। হঠাৎ একদিন আলতাফের মা পুলিশ ক্লাবে আমার কাছে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি কিছুই বুঝতে না পেরে তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি সব খুলে বললেন। তার ছেলেকে পুলিশি টর্চার থেকে বাঁচাতে কি-কি করতে হবে তা জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, “আমার আলতাফ আপনার সাথে দেখা করতে আমাকে পাঠিয়েছে।”
আগেই বলেছি, শিক্ষানবিশ অফিসার হিসেবে এসব ক্ষমতা আমার মোটেই ছিল না। তবুও মিথ্যা অভিনয় করে এই মায়ের মনকে হালকা করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম। তিনি আমাকে ‘ছেলে’ সম্বোধন করে আমার মিথ্যা আশ্বাসে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে সামান্য সান্ত্বনা নিয়ে ফিরে গেলেন৷
আসামি আলতাফকে পুলিশের সর্বোচ্চ থেরাপি দেবার পরও তার কাছ থেকে কোন অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত জেলে পাঠিয়ে ডিটেনশনে রাখা হয়েছিল।
আমার গোপন সংবাদদাতা আমাকে পুন:-পুন: তাগিদ দিতে লাগলো। সে নিশ্চিত যে, আলতাফের কাছেই আনসার বাহিনীর লুটের রাইফেল আছে। কিন্তু আমি নিজের চোখে আলতাফের উপর পুলিশের টর্চার দেখেছিলাম; তাই আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। তবুও একটু যাচাই করার পথ খুঁজতে লাগলাম৷
আলতাফ তখন ডিটেনশনে বরিশাল জেলে ছিল। তখন ডিটেনশনের আসামির সাথে দেখা করতে হলে মাননীয় জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুমোদন লাগতো। আমার মতো একজন শিক্ষানবিশ অফিসারের পক্ষে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুমোদন নেয়া সম্ভব ছিল না। তাছাড়া আমি কোন্অধিকারে এবং কি কারণে একজন ডিটেনশনের আসামির সাথে দেখা করবো তার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল না। ওসি সাহেবের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো এমন সাহস হলো না। কারণ কয়েকদিন আগে ওয়ারেন্টের আসামি ধরে গরীব মানুষ বিধায় তাদের ছেড়ে দিয়ে ওসি সাহেবের কুনজরে ছিলাম। আবার, বড় কোন অফিসারের কাছে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল।
তখন বরিশালের জেল সুপার ছিলেন শামসুর রহমান। তিনি আমাকে ছোট ভায়ের চেয়ে বেশি ভালবাসতেন। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা আরো বেশি বেশি আদর ও সম্মান করতেন। আমার বিয়ের পর জেল সুপার সাহেবের স্ত্রী আমার স্ত্রীকে বোন ডেকেছিলেন। এখনও আমাদের সেই সম্পর্কে একটুও ফাটল ধরেনি। আমরা এখন ধানমন্ডি এলাকায় পাশাপাশি দুই বিল্ডিংএ বসবাস করি এবং নিয়মিত যোগাযোগ রাখি।
আমি জেল সুপার সাহেবের কাছে গিয়ে সবকিছু খুলে বললাম। তিনি জেলখানার নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ডিটেনশনে থাকা আসামি আলতাফকে তাঁর রুমে ডাকিয়ে আনলেন। আমার সাথে আসামিকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে তিনি কাজের অযুহাত দেখিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমরা দু’জন আলাপ শুরু করলাম৷ পুলিশ রিমান্ডে থাকা অবস্থায় আলতাফ তার কষ্টের কাহিনী বলে কাঁদতে লাগলো। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে খাবার খেতে দিলাম। কিন্তু সে আমাকে ছাড়া খেতে রাজি হলো না। শেষমেশ জেল সুপার সাহেবের গোপন আয়োজনে দু’জনে একসাথে খাবার খেলাম। এক পর্যায়ে আলতাফ তার জীবনের কাহিনী আমাকে খুলে বললো। কিভাবে সর্বহারা পার্টিতে যোগ দিলো তার বিস্তারিত বিবরণ শুনে আমার শরীর শিউরে উঠলো। অবশেষে শিকারপুর ফেরিঘাটে আনসার বাহিনীর রাইফেল লুটের কাহিনী বর্ণনা করলো। কিন্তু আমাকে আগে থেকেই বলে নিয়েছিল যে, সে কোর্টে বা অন্য কোথাও একথা স্বীকার করবে না। আইন সম্পর্কে আগে থেকেই তার মোটামুটি ধারণা ছিল।
সবকথা শুনে আমি তাকে শিকারপুর ফেরিঘাটে আনসার বাহিনীর লুট হওয়া রাইফেল ফেরৎ দেবার অনুরোধ করলাম। কিন্তু সে পুরাপুরি সম্মতি না দিয়ে তার মাকে একবার জেলখানায় বা অন্য কোথাও দেখা করার ব্যবস্থা করতে আমাকে অনুনয়-বিনয় করলো। সে তার মাকে মনে থেকে ভালবাসতো। মাকে দেখার জন্য তার মনটা ছটফট করছিল। তার মা ঠিক একইভাবে ছেলেকে দেখার জন্য ছটফট করছিলেন।
কয়েক ঘন্টার আলাপ শেষে তাকে আবার জেলে পাঠিয়ে দিয়ে আমি জেল সুপার সাহেবের কাছে গিয়ে আলাপের সারাংশ জানালাম এবং আলতাফের মায়ের সাথে দেখা করার ইচ্ছে সম্পর্কে আলাপ করলাম। তিনি অনেক চিন্তা ভাবনা করে নিজের চাকরির ঝুঁকি নিয়ে আমার প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন।
একদিন আলতাফের মা তার ছেলের জন্য নিজের হাতে রান্না করে খাবার নিয়ে পুলিশ ক্লাবে এলেন। সাথে আমার জন্য খাবার আনতে ভুল করেননি। আমি তাকে সাথে নিয়ে জেল সুপার সাহেবের কাছে গিয়ে আলতাফের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলাম। তিনি একটি বিশেষ রুমে তাদের দেখা করার ব্যবস্থা করলেন। আমিও সেখানে হাজির থাকলাম। আলতাফ তার মায়ের আনা খাবার পেট পুরে খেলো। এক পর্যায়ে আলতাফ তার মায়ের সাথে একা একা কথা বলার ইচ্ছে প্রকাশ করায় আমি কিছুটা দূরে সরে গেলাম। কিছু সময় পর তারা আমাকে ডেকে কাছে নিলো। তখন আলতাফ আমাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতে লাগলো এবং তার মা আমাকে ‘তুমি’ বলতে শুরু করলেন। আমি তাতে কোন আপত্তি না করে বরং খুশি হলাম। শেষ পর্যন্ত আলতাফ বললো, “ভাই, একদিন রাতে আপনি একা একা আমার মায়ের কাছে যাবেন। মা আপনাকে সব কথা খুলে বলবে। কেউ যেন না জানে। তাহলে আমার মাকে পার্টির লোকেরা মেরে ফেলবে”। আমার সামনে আলতাফ তার মাকে শুধু বললো, “মা, তোমাকে যেভাবে বললাম তুমি সেভাবে ভাইকে জিনিসটা দিয়ে দিও। তোমার কোন অসুবিধা হবে না। ভাই খুব ভাল মানুষ।”
আলতাফের কথা বুঝতে আমার তেমন অসুবিধা হলো না। তবে রাতে বাবুগঞ্জ থানার সর্বহারা কবলিত এলাকায় একা একা যাবার কথা শুনে আমার শরীর শিউরে উঠলো। তাদের কিছু বুঝতে না দিয়ে আলতাফের মাকে জেলখানার সেই বিশেষ কক্ষ থেকে বাড়ির উদ্দেশ্য বিদায় করার আগে বাজারে নিয়ে একটা শাড়ি কিনে দিলাম। তিনি খুশি মনে বিদায় নিলেন।
কথাগুলো যত সহজে এখন লিখছি, প্রকৃত বিষয়টি তখন ছিল ঠিক তার বিপরীত। আমার বুকের ভিতর বার বার ধড়ফড়িয়ে উঠতে লাগলো। পুলিশের ক্রান্তিলগ্নে লুটের অস্ত্র উদ্ধার করার নেশা আমাকে পুলকিত করতে লাগলো। অন্যদিকে জীবন বাজি রেখে রাতের অন্ধকারে বাবুগঞ্জের সর্বহারা কবলিত সন্ত্রাসী এলাকায় যাওয়ার কথা মনে উঠলে গায়ে কাঁটা দিতে থাকলো। এসব নিয়ে কারো সাথে পরামর্শ করার উপায়ও ছিল না।
কারণ অনেক। যেমন : লোক জানাজানি হলে কাজটা হাতছাড়া হতে পারে৷ আলতাফ যদি বেঈমানী করে তাহলে জীবন মরণ সমস্যা হতে পারে। উর্ধ্বতন অফিসারের সাথে আলাপ করার পর যদি অস্ত্র উদ্ধার না হয় তখন সন্ত্রাসীদের সাথে আমার গোপন আঁতাত আছে এই সন্দেহে চাকরির ক্ষতি করতে পারে।
এতসব বিপদের সম্ভাবনা থাকার পরও মনে মনে ঠিক করলাম এসপি সাহেবের সাথে দেখা করে সবকথা খুলে বলবো। তাই একদিন সুযোগ বুঝে ভয়ে ভয়ে এসপি সাহেবের রুমে অতি গোপনে ঢুকে পড়লাম। তিনি আমার কাছে সবকিছু খোলামেলা শুনতে চাইলেন। আমি তাঁর কাছে সবকিছু সত্য বললাম; তবে বিভিন্ন কারণে কিছু কথা বাধ্য হয়ে গোপন রাখলাম।
আমার কথা শুনে এসপি সাহেব মোটামুটি আশ্বস্ত হলেন। তাঁর চোখেমুখে হাসি ফুটে উঠলো। চাকরি জীবনে তিনি কখনও এমন সংকটে পড়েননি। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলে তাঁর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে; অন্যথায় ঠিক বিপরীত ফল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। অনেক চিন্তা ভাবনা করে তিনি আমাকে বললেন, “তোমাকে একা একা রাতের আঁধারে বাবুগঞ্জ পাঠাতে আমার সাহস হচ্ছে না। তাদের বিরুদ্ধে আমরা অনেক কঠোর অবস্থানে গিয়ে অনেককে আটক করেছি। এখন তোমাকে একা পেয়ে যদি প্রতিশোধ নেয় তখন আমি আরো বিপদে পড়বো। তোমার কিছু হলে আমি কিভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দেব। তার চেয়ে তুমি ঐ মহিলাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে বুঝিয়ে বলবো।”
আলতাফের মা প্রায়ই আমার সাথে দেখা করতেন৷ আমার ও আলতাফের জন্য খাবার রান্না করে আনতেন। জেল সুপার সাহেবের বদৌলতে আলতাফ ডিটেনশনের আসামি হওয়া সত্বেও তাকে খাবার দিতে অনুমতির প্রয়োজন হতো না। কিন্তু এসপি সাহেবের কথামতো আলতাফের মাকে দেখা করার কথা বলতেই তিনি বেঁকে বসলেন। কোন প্রকারে তাকে রাজি করানো গেল না। দুনিয়ার কোন পুলিশের উপর তার আস্থা নেই বলে জানিয়ে দিলেন। আমি তাকে বললাম – ‘এসপি সাহেব যদি নিজে আপনার বাড়িতে যান তাহলে অসুবিধা হবে?’
তাতে তিনি আরো বেশি ঘাবড়ে গেলেন। অবশ্য অনেক বলে-কয়ে তাকে শেষ পর্যন্ত রাজি করালাম। কিন্তু অনেকগুলো শর্ত জুড়ে দিলেন। আমি সকল শর্ত মেনে নিয়ে আবারও এসপি সাহেবের কাছে গিয়ে সবকথা বলার সাথে সাথে তিনি আলতাফের মায়ের কাছে যেতে বিশাল আগ্রহ প্রকাশ করলেন। কারণ আনসার বাহিনীর লুন্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তাঁর চাকরি ছিল টলটলায়মান।
ঐ রাতেই এসপি সাহেব তাঁর গাড়িতে কয়েকজন ফোর্স ও আমাকে নিয়ে বাবুগঞ্জ রওয়ানা দিলেন। পুলিশের অন্য কোন সদস্য যাতে কোনকিছুই জানতে না পারে সে বিষয়ে তিনি সজাগ দৃষ্টি রাখলেন। আলতাফের বাড়ি থেকে বেশ কিছু দূরে আমার অনুরোধে এসপি সাহেব গাড়ি থামাতে নির্দেশ দিলেন। ফোর্স ও গাড়ি সেখানে রেখে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। আমার কাছে ছিল একটা ৭.৬২ চাইনিজ পিস্তল ও দুই ম্যাগজিন ভর্তি গুলি। আমি সেটা লোড করে হাতে নিলাম। এসপি সাহেবের নিজস্ব একটি ছোট পিস্তল ছিল। তিনিও সেটা লোড করে হাতে নিলেন।
কিছুদূর হাঁটার পর আলতাফের বাড়িতে গিয়ে দরজায় আস্তে টোকা দিয়ে মৃদু স্বরে বললাম, ‘খালা আমরা এসেছি।’
খালা জেগেই ছিলেন। তবুও দরজা খুলতে বেশ কিছু সময় নিলেন। হয়তো তিনি আমাদের মতি মতলব ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তারপর দরজা খুলে বারান্দায় এলেন। আমি অন্ধকারে এসপি সাহেবের পরিচয় দিতেই তিনি কিছুটা বিচলিত হলেও সালাম দিয়ে বসতে বললেন। এসপি সাহেব খুব সাদাসিধাভাবে বারান্দায় হাঁটু গেড়ে বসে আলতাফের মাকে আশ্বস্ত করার জন্য সরাসরি ‘মা’ বলে সম্বোধন করলেন। আলতাফের মা অন্ধকারে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। কয়েক মিনিট আলাপ করার পর আশাতীত ফল পাওয়া গেল না। এসপি সাহেব যখন লুন্ঠিত রাইফেল চাইলেন তখন আলতাফের মা কিছুটা চুপ থেকে বললেন, “আগামীকাল দিনের বেলা আসতে হবে। আজ আমি যোগাড় করতে পারিনি।”
এসপি সাহেব সামান্য বিরক্ত হলেও রাগ করলেন না। তিনি আমাকে একা একা কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে দূরে চলে গেলেন। আমি অসহায়ের মতো আলতাফের মাকে বুঝাতে চেষ্টা করেও কোন ফল হলো না। তিনি বললেন, “আমি অনেক চেষ্টা করেও জিনিস হাতে পাইনি। কাল পাবো বলে মনে হয়। তুমি দুপুরের পরে একা একা মোটর সাইকেলে এসো। আমি তোমাকে এক বস্তা বেগুন দিবো। ঐ বেগুনের বস্তার ভিতরে একটা রাইফেল থাকবে। রাইফেলটা কেটে দুই ভাগ করা আছে।”
আমি এসপি সাহেবের কাছে গিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করলাম। তিনি আমার কথায় বিশ্বাস করে ফিরে আসলেন। পরদিন দুপুরে খাওয়ার পর আমি মোটরসাইকেল নিয়ে আলতাফের মায়ের কাছে হাজির হলাম। পূর্বের কথামতো তিনি আমাকে এক বস্তা বেগুন মোটরসাইকেলের পিছনে বেঁধে দিলেন। আমি বেগুনের বস্তা নিয়ে সোজা এসপি সাহেবের অফিসে হাজির হলাম। ভয়ে ভয়ে বস্তা খুলে বেগুনের সাথে দু’ টুকরো করা একটা ৩০৩ রাইফেল পেলাম। নম্বর মিলিয়ে দেখা গেল শিকারপুর ফেরিঘাটে আনসার বাহিনীর রাইফেলের সাথে হুবহু মিল আছে। এসপি সাহেব মহা খুশি হলেন। কিন্তু অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা তখন জানাজানি করলেন না। পরবর্তীতে আলাদা বিশেষ অভিযানে রাইফেলটি উদ্ধার দেখানো হয়েছিল।
পুলিশের চাকরিতে কোনকিছু গোপন রাখা খুব কঠিন। কয়েকদিনের মধ্যে প্রায় সকলেই জেনে গেল যে, পিএসআই কামরুল ইসলাম ও এসপি সাহেব গোপনে একটি রাইফেল উদ্ধার করেছে। তাতে আমার কাজের দক্ষতা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা দু’টোই সমান তালে চলতে থাকলো। কারো কাছে হলাম প্রশংসিত ; আবার কেউ কেউ আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে শত্রুতা শুরু করলো। ইংরেজিতে যাকে বলে – professional jealousy.
আনন্দ
পুলিশের দুর্দিনে একজন শিক্ষানবিশ অফিসার হয়েও লুন্ঠিত রাইফেল কৌশলে উদ্ধার করে সামান্য গর্বিত হলাম।
অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র যার কাছে পাওয়া যায় প্রাথমিকভাবে তাকেই আসামি করে মামলা হওয়ার কথা; কিন্তু, আমার সম্মান ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে আলতাফের মায়ের বিরুদ্ধে কোন মামলা নেয়া হয়নি। এজন্য ভাল লেগেছিল।
আমার চাকরি জীবনের শুরুতে অসাধারণ সাফল্যের জন্য প্রশংসিত হয়েছিলাম।
এই ঘটনার পর থেকে আমি এসপি সাহেবের বিশেষ সুনজরে পড়ে গেলাম। জেলার সকল ভাল অফিসার আমাকে বেশি বেশি ভালবাসতে লাগলেন।
আমার শিক্ষানবিশকাল শেষ হবার সাথে-সাথে আমাকে বরিশাল কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার হিসেবে পোস্টিং দেয়া হলো।
বেদনা
আমার এই অভাবনীয় সাফল্যে অনেকেই ঈর্ষা করতে শুরু করে।
অস্ত্রের সন্ধান পেয়ে আমার ইমিডিয়েট বসদের খবর না দিয়ে সরাসরি এসপি সাহেবের সাথে জানানোর কারণে অনেকেই আমার শত্রু হয়ে পড়লো। কেউ কেউ আমাকে বিপদে ফেলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো।
আমার ভাল কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ শিক্ষানবিশকাল শেষ হবার সাথে সাথে কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার হিসেবে পোস্টিং দেয়ায় আমার ব্যাচমেটরা ভীষণ মনক্ষুণ্ণ হলো।
চলবে …
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)
খুলনা গেজেট/এমএনএস