খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

শাহাবুদ্দিন ভাই কখনো নীতির সাথে আপোষ করেননি

শেখ দিদারুল আলম

একে একে চলে যাচ্ছেন খুলনা সাংবাদিক জগতের উজ্জল তারাগুলো। যাদের পথ ধরে আমাদের পথ চলা, তারা প্রায় সকলেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। শুধু আমাদের মধ্যে ইতিহাসের শেষ ভরসা হিসেবে এখনো আছেন আমাদের বড় ভাই মনিরুল হুদা (আলহামদুলিল্লাহ)।

আজ শনিবার ভোর রাত তিনটা একুশ মিনিটে হারিয়েছি আমাদের চলার পথে অগ্রজ শাহাবুদ্দিন ভাই কে। রাত তিনটা চল্লিশ মিনিটে মরহুমের ভাগ্নে যখন ঢাকা থেকে মোবাইল করলেন তখন মনে করলাম কোন খারাপ সংবাদ হবে। নাহলে এত রাতে কেউ ফোন করে না। অপর প্রান্ত থেকে কান্না জড়িত কন্ঠে জানালেন কুনটু মামা মারা গেছেন। কুনটু শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের ডাক নাম। আদর করে বাবা মা সহ পরিবারের সদস্যরা এই নামে তাকে ডাকতেন।

আপাদমস্তক সাংবাদিক এই মানুষটি প্রায় ৫০ বছর সাংবাদিকতা করেছেন। কিন্তু কোন দিন নীতির সাথে আপোষ করেননি। কোনদিন কোন মহলের নিকট থেকে অনৈতিক সুবিধা নেননি। আমার দেখা মতে অনেক সরকারি ও বেসরকারি হোমড়াচোমরা তাকে সুবিধা দেওয়ার জন্য তার পিছনে পিছনে ঘুরছে, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখান করেছেন। যে কোন সংবাদের বিষয় তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাবধানী। একটা নিউজ নিজে সংগ্রহ করতেন বা অপরের কাছ হতে নিলেও কয়েকবার চেক এবং ক্রস চেক করে তবেই নিউজটি ঢাকায় পাঠাতেন। তিনি বলতেন, নিউজ পাঠাবে কিন্তু ভুল নিউজ বা গুজব নিউজ পাঠাবে না। যখন ফ্যাক্স ছিল না, আজকের মত ই-মেইল ছিল না, তখন খুলনা টেলিফোন অফিসের টেলিটোককা মেশিনে নিউজ পাঠানো হতো। আমাদের অনেক সিনিয়র সাংবাদিক নিউজটি জমা দিয়ে চলে আসতেন। পরে অপারেটর সেটা পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু শাহাবুদ্দিন ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। যত সময় তার নিউজ পাঠানো না হতো ততক্ষণ তিনি অপারেটরের পাশে বসে থাকতেন। পাঠানোর পর আবারও অপারেটর কাছে জানতে চাইতেন ঠিক মত নিউজ গেছে কিনা। এত সিরিয়াস ছিলেন নিউজের ব্যাপারে আমাদের শাহাবুদ্দিন ভাই।

সময় ঠিক রাখার ব্যাপারে শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের জুড়ি নেই। যদি বলতেন সকাল নয়টা। তবে নয়টাই। এর আগেও নয়, পরেও নয়।

তিনি যে কত সাংবাদিককে গোপনে সহযোগিতা করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। দৈনিক ইত্তেফাকের এক সময়ের খুলনা প্রতিনিধি ফারুক ভাইয়ের ইন্তেকালের পর তার পরিবারকে কয়েক বছর যাবত সহযোগিতা করেছেন। এমন অনেক সাংবাদিক তার সহযোগিতা লাভ করেছেন। তার জীবনটা ছিল নিয়মশৃঙ্খলা এবং নিয়ন্ত্রিত। খালিশপুর হাউজিং কোয়ার্টারে থাকতেন। খুলনায় থাকাকালীন প্রতিদিন সকাল নয়টায় বাসা থেকে বের হয়ে এবি ব্যাংক বা আইএফআইসি ব্যাংকে আসতেন। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে প্রেসক্লাবে আসতেন। তারপর নিউজের জন্য খুলনা সদর থানা ঘুরে খুলনা ক্লাবে যেতেন। খুলনা ক্লাবের অধিকাংশ সদস্য তাকে মামা বলে ডাকতেন। রাতে খুলনা ক্লাবে বেশী সময় দিতেন।

তিনি একটা কথা বলতেন, যেখানে নিউজের গন্ধ পাবে সেখানে দাওয়াত না দিলেও যাবে। তবে খাওয়ার দাওয়াত থাকলে না বললে সেখানে যাবে না। আর সত্যিকারের সাংবাদিক যখন নিউজ করবে তখন দল বা রাজনীতি গুরুত্ব পাবে না। বলতেন নিউজের নিরপেক্ষতা রাখবে। যদি নিউজের মধ্যে একাধিক গ্রুপ থাকবে তবে সকলের মতামত নিবে। আর প্রেসক্লাবে যখন প্রবেশ করবে তখন তোমার নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয়কে বাইরে রেখে আসবে।

শাহাবুদ্দিন ভাই পিতা শামসুদ্দিন আহমেদ। তিনি সরকারি ডাক্তার ছিলেন। পিতার চাকরির সুবাদে তিনি দেশের অনেক জায়গায় ঘুরেছেন। তারা দশ ভাই বোন। সাতবোন ও তিন ভাই। ভাই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয় এবং ভাইদের মধ্যে ২য়। তার ছোটভাই জালালুদ্দিন আহমেদ দৈনিক বাংলার সাংবাদিকতা করেছেন। ভাইরা এখন কেউ আর বেঁচে নেই।

১৯৩৯ সালে সাভারের গেনডা গ্রামে জন্ম হওয়া এই সাংবাদিক খুলনা বিএল কলেজ থেকে ইংরেজিতে লেখা পড়া শেষ করেন। এরপর খুলনা মডেল ও ফাতিমা বিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিদ্যালয়ে শিক্ষাকতা করেন। আমাদের প্রয়াত সাংবাদিক ভোলাদা তার সরাসরি ছাত্র ছিলেন।

শাহাবুদ্দিন ভাই ওয়েভ প্রতিকার মাধ্যমে ১৯৬৫ সালে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন। তিনি কখনো বাংলা কাগজে সাংবাদিকতা করেন নাই। তিনি হলিডে, বাংলাদেশ টাইমস, দি ডেইলি টেলিগ্রাফ, দি ডেইলি ইনডিপেনডেন্ট খুলনার দায়িত্ব পালন করেছেন।

কয়েক বছর আগে বয়সের ভারে আজীবন অবিবাহিত এই মানুষটি ঢাকায় বসুন্ধরায় তার বড় বোন জেবুননেছা বেগমের কাছে চলে যান এবং সেখানে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। শাহাবুদ্দিন ভাই ছিলেন খান বংশের মানুষ। তার আপন চাচাতো ভাই বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বিএনপির নজরুল ইসলাম খান তার খালাতো ভাই।

সবশেষে সততার প্রতীক এই সাংবাদিকদের জান্নাত কামনা করছি আল্লাহর দরবারে।

(লেখক : সাংবাদিক ও অধ্যাপক, খুলনা প্রতিনিধি, ইউএনবি)

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!