খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

শাপে বর : আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল

এ এম কামরুল ইসলাম

দিন যত গড়াতে লাগলো ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টি ততই কঠিন থেকে কঠিনতর হতে লাগলো। আমার উজান বাওয়া স্বভাবের প্রতিফলন ঘটতে শুরু হলো। ক্ষমতাসীনদের চোখে আমি চিরকালই বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত ছিলাম। আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনরা সরকারি অফিসে ক্ষমতা জাহির করে নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রদর্শন করতে পছন্দ করে। কোন অফিসার ক্ষমতাসীনদের অযাচিত তদ্বির অগ্রাহ্য করলেই সেই অফিসারকে বিরোধী দলের সমর্থক হিসেবে কালিমা লেপে দেয়। আমার কপালে সারা চাকরি জীবনে এই কালিমা যথেষ্ট বেশি জুটেছিল। তাই বেশিদিন এক স্টেশনে কাজ করার সৌভাগ্য আমার কখনও হয়নি।

যাক সেসব কথা। হঠাৎ একদিন খবর পেলাম খালিশপুর থানা থেকে আমার পার্বত্য চট্টগ্রামে শাস্তিমূলক বদলি হয়েছে। বদলির আদেশ পেয়ে পুলিশ কমিশনার জনাব ওসমান আলী খান সাহেব মাননীয় আইজিপি মহোদয়কে ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন –

-আমার সবচেয়ে ভাল অফিসারকে শাস্তিমূলক বদলি করলেন স্যার, কিন্তু আমাকে একবার জিজ্ঞেস করলেন না!

তারপর আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন,

– আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। তুমি আপাততঃ থানার দায়িত্ব নতুন ওসিকে বুঝে দিয়ে ঘুরে বেড়াও। তোমার বাড়ি খুলনায়, আত্মীয় স্বজন খুলনায়। অতএব মন মতো ঘুরে বেড়াও। দেখি কী হয়।

আমারও তেমন কোন ক্ষোভ ছিল না। তাই নতুন ওসি জনাব আব্দুল কুদ্দুস খান সাহেবকে থানার দায়িত্ব বুঝে দিয়ে মনের সুখে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।

প্রায় মাস খানেক চলে গেল। হঠাৎ একদিন পুলিশ কমিশনার মহোদয় আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন,

-জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশ থেকে কিছু পুলিশ অফিসার নিবে। খুলনা মেট্রোপলিটন থেকে একজন ইন্সপেক্টর চেয়েছে। সকল আগ্রহী ইন্সপেক্টরের পরীক্ষা নিয়ে বাছাই করে একজনের নাম পাঠাতে বলেছে। আমি পরীক্ষা ছাড়াই তোমার নাম পাঠাবো। আশাকরি ঢাকায় গিয়ে চুড়ান্ত পরীক্ষায় তুমি তোমার যোগ্যতা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে আমার সম্মান রক্ষা করবে। এখানকার নেতারা তোমাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠিয়েছে, আমি তোমাকে আরো দূরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। জাতিসংঘ মিশনে চান্স পেলে তোমার কপাল খুলে যাবে ইনশাআল্লাহ।

জাতিসংঘ মিশণ সম্পর্কে তখন আমার তেমন ধারণা ছিল না। কিন্তু পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের কথা শুনে আমার বেশ ভাল লেগেছিল। তাই অধীর আগ্রহ নিয়ে ঢাকা থেকে ডাক পাবার অপেক্ষায় থাকলাম। কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকা থেকে ডাক এলো। পুলিশ কমিশনার মহোদয় আমাকে তার অফিসে ডেকে আদেশ উপদেশ দিয়ে বললেন,
-তোমার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে?

-না, স্যার।

-তুমি এখনই এডিসি জেনারেল সাহেবের কাছে যাও। আমি তাঁকে ফোন করছি। আজই ড্রাইভিং লাইসেন্স করে আগামীকাল ঢাকায় রওয়ানা দাও। ওখানে চুড়ান্ত পরীক্ষা হবে।

আমি সাথে সাথে ডিসি অফিসে গিয়ে এডিসি জেনারেল সাহেবের সাথে দেখা করতেই তিনি আমার আবেদন নিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে দিলেন। প্রসংগতঃ বলে রাখি, তখন ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে এখনকার মতো এতো জটিলতা ছিল না। বিশেষ করে সরকারি অফিসারদের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল অত্যন্ত সহজসাধ্য।

পরদিন সকালে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে সোজা পুলিশ সদর দপ্তরে হাজির হলাম। তখন পুলিশ সদর দপ্তর ছিল সচিবালয়ের মধ্যে। সারা দেশ থেকে অনেক অফিসার চুড়ান্ত পরীক্ষার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে হাজির ছিলেন। ডিআইজি থেকে সাব ইন্সপেক্টর পর্যন্ত সবার একসাথে পরীক্ষা হলো। অনেক সৌভাগ্যবানের মধ্যে আমার নামটাও পাশের খাতায় উঠে গেল। টানা দুই দিন পরীক্ষার পর চুড়ান্ত বিজয়ীদেরকে মাননীয় আইজিপি মহোদয় ব্রিফিং করলেন। তৎকালীন আইজিপি জনাব এনামুল হক সাহেব ছিলেন অত্যন্ত মেধা সম্পন্ন। তিনি একবার কারো নাম শুনলে দীর্ঘদিন মনে রাখতে পারতেন। ব্রিফিং শেষে আইজিপি মহোদয় বললেন,
-কেএমপি থেকে ইন্সপেক্টর কামরুল এসেছিল, সে কি পাশ করেছে?

আমি ছিলাম মাঝামাঝি সারিতে। আইজিপি মহোদয় আমার নাম বলায় আমি রীতিমতো ঘামতে শুরু করলাম। দুরুদুরু কণ্ঠে আমার উপস্থিতি জানান দিতে বললাম,

-জী স্যার, আমি চান্স পেয়েছি।

-আপনি সামনে আসেন।

এবার আমি আরো ঘাবড়ে গেলাম। কোনমতে আইজিপি মহোদয়ের সাননে গিয়ে স্যালুট দিয়ে দাঁড়ালাম।
তিনি শান্ত ও স্বস্তির সুরে বললেন,

-ওরা আপনাকে পার্বত্য জেলায় বদলি করতে আমাকে বাধ্য করেছে। আমি তখন আপনার জন্য কিছুই করতে পারিনি। আমার জানামতে কম্বোডিয়া আরো পার্বত্য এলাকা এবং আরো অনেক দূর। অতএব এখন তারা ভীষণ খুশি হবে। আশাকরি আপনিও খুশি হয়েছেন। আমার দোয়া থাকলো। আপনি দেশের সুনাম বয়ে আনতে চেষ্টা করবেন।

আমি সব কথা শুনে বললাম,
-দোয়া করবেন স্যার।

ব্রিফিং শেষে পলওয়েল মার্কেটে জাতিসংঘের পোশাক ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র কিনতে এবং সহকর্মীদের সাথে পরিকল্পনা করতে কয়েকদিন কেটে গেল। সরকারি পাসপোর্ট, জিও এবং ভিসা পেতে লাগলো আরো কয়েকদিন। তারপর আবার খুলনায় ফিরে গিয়ে ফ্লাইটের অপেক্ষায় থাকলাম।

এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। যে ঘটনা আজো আমাকে কাঁদায়। খুলনা মেট্রোপলিটন থেকে শামীম আহসান নামে আমার সাথে আর একজন সাব ইন্সপেক্টর এই মিশনে চান্স পেয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় মেডিকেল টেষ্টে তার হেপাটাইটিস ‘বি’ পজিটিভ ধরা পড়ায় তাকে মিশন থেকে বাদ দেওয়া হলো। সে মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়ে কান্নাকাটি শুরু করলো। ডাক্তারদের সাথে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করেও কোন ফল হলো না। এক পর্যায়ে সে আমার শরণাপন্ন হলো। আমার হাতেও তেমন কিছু করার ছিল না। কিন্তু শামীমের কষ্টে আমি মারাত্মক ব্যাথীত ছিলাম। সকল চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর শামীম আমাকে প্রস্তাব দিলো,
– স্যার, আমার নামে আপনার রক্ত দিয়ে পরীক্ষা করালে আমি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।

বিষয়টি আমার নীতি বিরুদ্ধ হলেও আমি বললাম,
-তুমি মেনেজ করতে পারলে আমি রক্ত দিতে রাজি আছি।

শেষ পর্যন্ত তাই করলাম এবং শামীম রক্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমাদের সাথে মিশনে গেল। মিশনে যাবার পর আমি তাকে চোখে চোখে রাখতাম। এমনকি মিশন থেকে দেশে ফেরার পরেও শামীমকে আমার থানায় পোস্টিং করিয়ে নিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে তার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে চিকিৎসা করানোর তাগিদ দিতাম। কিন্তু সে টাকা খরচের ব্যাপারে মারাত্মক সচেতন ছিল। কম্বোডিয়া থাকাকালীন আমাদের থাইল্যান্ড ভ্রমণ ফ্রী থাকায় সেখানে চিকিৎসা করার জন্য বার বার পরামর্শ দিতাম। তবুও সে রোগ গোপন করে চলতো। অবশেষে দেশে ফেরার দুই তিন বছর পর সে আকস্মিকভাবে অল্প বয়সে সকলকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যায়। তার মৃত্যুর খবর শুনে আমি নিজেকে অপরাধী ভেবেছিলাম। আমি যদি সেদিন আমার রক্ত দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় না নিতাম তাহলে তার মিশনে যাওয়া বন্ধ হলেও সে হয়তো চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে আবার অন্য মিশনে যেতে পারতো।
আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে শামীমকে বেহেস্ত নসীব করুক।

ঢাকার সকল কার্যক্রম শেষ করে খুলনায় ফিরে মাননীয় পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের সাথে দেখা করতে গিয়ে আর একবার বিস্মিত হলাম। জাতিসংঘ মিশনে চান্স পাবার সংবাদ মাননীয় পুলিশ কমিশনার মহোদয়কে জানানোর পর তিনি খুশি হয়ে বললেন,

-তোমার জন্য আর একটা খবর আছে। জানিনা এই খবরটা তোমার জন্য ভাল না, খারাপ।
তারপর একটা কাগজ আমার হাতে দিলেন। ঐ কাগজ হাতে পেয়ে দেখলাম সেটা আইজিপি মহোদয়ের স্বাক্ষরিত। সেই আদেশে লেখা ছিল-

“যেহেতু পুলিশ পরিদর্শক এ এম কামরুল ইসলাম কেএমপি, খুলনা জাতিসংঘ মিশন কম্বোডিয়ার জন্য নির্বাচিত হইয়াছেন, সেহেতু তাহার পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় বদলির আদেশ এতদ্বারা বাতিল করা হইলো”।

আমি আগেই বলেছি, ঐ কাগজটা দেখে আমি সত্যি বিস্মিত হয়েছিলাম।

বেশ কয়েকদিন আবেগ উৎকন্ঠার পর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। ১৯৯২ সালের আগষ্ট মাসের কোন একদিন আমরা জাতিসংঘ মিশন কম্বোডিয়ার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম। মিশনে রওয়ানা দেওয়ার আগে পর্যন্ত অপেক্ষার দিনগুলো ছিল অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। জাতিসংঘ মিশনের অভিজ্ঞতা তখন বাংলাদেশ পুলিশে সবে শুরু হয়েছিল। তাই জল্পনা কল্পনার অন্ত ছিল না। এর আগে বাংলাদেশ থেকে নামিবিয়া মিশনে স্বল্প কয়েকজন অফিসার কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁদের কাছে অভিজ্ঞতার কথা শুনতে বার বার ধর্ণা দিতেও ভুল করতাম না।

অবশেষে বিমানে চড়ার সময় মাননীয় আইজিপি মহোদয় ও পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের কথাগুলো বার বার মনে পড়ছিল। তাঁরা আমাকে অনেক দূরের দেশে পার্বত্য এলাকায় পাঠিয়ে দিয়ে মনে মনে তৃপ্ত ছিলেন। আমি তাঁদের তৃপ্তির কারণ না বুঝেই তৃপ্ত ছিলাম।

সরল মনে উজান বাইলে আল্লাহর তরফ থেকে ফল ভাল হতে পারে তা বুঝতে পেরেছিলাম কম্বোডিয়া জাতিসংঘ মিশনে যাবার পর। ‘শাপে বর’ বলে একটা প্রবাদ ছোটবেলা থেকে শুনতাম। সেই প্রবাদ বাক্যটি আমার জীবনে প্রতিফলিত হলো। আমার উজান বাওয়ার ইচ্ছে আরো প্রবল হলো। আর একবার মনে হলো, আল্লাহ যা নির্ধারণ করেন, তা সকলের মঙ্গলের জন্য করেন।

আনন্দ

জাতিসংঘ মিশনে গিয়ে বুঝেছিলাম আল্লাহর বিচার কত সুক্ষ্ম। তাঁর সকল নিয়ামত আমার উপর ছিল।

আমার আর্থিক স্বাবলম্বিতার শুরু হয় এই মিশন থেকে। আজও সেই সুফল ভোগ করছি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুলিশ ও বহির্বিশ্বের সাথে পরিচিত হওয়ার এটাই ছিল আমার প্রথম সুযোগ। পরবর্তী জীবনে এর সুফল ভোগ করেছি।

আল্লাহ কাউকে উপরে উঠাতে চাইলে মানুষ তাকে কখনও নিচে নামাতে পারে না। এই উপলব্ধি আবার উপভোগ করলাম।

সঠিক পথে থেকে উজান বাইলে আল্লাহ সহায় থাকেন। অন্যায়ের সাথে বেশি আপোষ করলে একদিন প্রতিফল ভোগ করতে হয়।

বেদনা

জাতিসংঘ মিশনে এক বছর থাকার কারণে আমার স্ত্রী,সন্তান আমার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত ছিল। বিশেষ করে আমার তিন মাস বয়সের ছেলেকে দূরে রেখে বিদেশে অবস্থান মনোকষ্টের কারণ ছিল। চলবে…

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!